১. দৃশ্যমান ও প্রকৃত সত্তা
যুক্তিবদ্ধ কোন মানুস সংশয় প্রকাশ করতে পারে না, এমন কোন সুনিশ্চিত জ্ঞান কি পৃথিবীতে বর্তমান আছে? আপাতদৃষ্টিতে প্রশ্নটি খুবই সহজবোধ্য মনে হলেও অনেক অতীব কঠিন প্রশ্নের মধ্যে এটি একটি। আমরা যখন সহজসরল ও সুনিশ্চিত উত্তরের সামনে প্রতিবন্ধকতা অনুভব করি, বলা যেতে পারে তখনই আমরা দর্শনচর্চার ক্ষেত্রে প্রবেশ করি। দর্শনশাস্ত্রে এই ধরণের মূল প্রশ্নসমূহের উত্তর দেবার চেষ্টা করে, কিন্তু উদাসীন বা অযৌক্তিকভাবে নয়–আমরা প্রাত্যহিক জীবনযাত্রায় যেভাবে দিয়ে থাকি, এমনকি বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও। দর্শন কিন্তু বিচার-বিবেচনাপূর্বক উত্তর দেবার চেষ্টা করে যে যে বিষয় এই প্রশ্নগুলোকে গোলমেলে করে তুলেছে তাদের খুঁজে বের করার পর এবং আমাদের ধরণাসমূহের মধ্যে ভ্রান্তিমূলক ও দোদুল্যমান যেসব বিষয় প্রচ্ছন্নভাবে অবস্থান তাদের অনুধাবন করার পর।
প্রাত্যহিক জীবনযাপনে আমরা সুনিশ্চিত বলে অনেক কিছু গ্রহণ করে থাকি, কিন্তু ভালভাবে পর্যালেচনা করার পর দেখা যায় সেগুলো পরস্পর আপাত বিরোধিতায় পূর্ণ। শুধুমাত্র গভীর চিন্তাভাবনাই আমাদের জানতে সাহায্য করে। বিষয়টির প্রকৃত সত্তা, যা আমরা নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করতে পারি। স্বাভাবিকভাবে আমাদের বর্তমান অভিজ্ঞতালব্ধ ধারণাসমূহ দিয়েই নিশ্চিততত্ত্বের খোঁজ শুরু করা উচিত, কোন কোন ক্ষেত্রে এদের থেকে কিছু জ্ঞানও অর্জন করা যেতে পারে। বিষয়টি কি–এ সম্বন্ধে আমাদের তাৎক্ষণিক লব্ধ অভিজ্ঞতা সম্বন্ধে কোন বক্তব্য কিন্তু ভুল হবার দিকে যেতে পারে। এটা আমার মনে হতেই পারে যে আমি এখন একটি চেয়ারে বসে আছি কোন একটি বিশেষ আকারের টেরিলের সামনে, যার ওপরে ছাপা অথবা হাতে-লেখা কিছু কাগজপত্র দেখতে পাচ্ছি। পিছনে তাকালে জানালা দিয়ে বাড়িঘর, মেঘ ও সূর্য দেখতে পাচ্ছি। আমার বিশ্বাস সূর্য পৃথিবী থেকে প্রায় তিরানব্বই মিলিয়ন মাইল দূরে অবস্থিত একটি জ্বলন্ত গোলাকার অগ্নিপিন্ড যা পৃথিবীর থেকে অনেকগুণ বড়, পৃথিবীর আহ্নিক গতির কারণে সূর্য প্রতিদিন সকালে ওঠে এবং ভবিষ্যতেও অনন্তকাল ধরে উঠবে। কোন স্বাভাবিক ব্যক্তি আমার ঘরে এলে এই চেয়ার, টেবিল, বই এবং কাগজপত্র দেখবে যেমন আমি দেখছি এবং যে টেবিলটা আমি আমার দৃষ্টি-ইন্দ্রিয় দিয়ে দেখছি এবং হাত ছুঁইয়ে স্পর্শ-ইন্দ্রিয় দ্বারা অনুভব করছি তা একই জিনিস। এসব বিষয়গুলো এতই প্রমাণ নিরপেক্ষ যা বলারই অপেক্ষা রাখে না শুধুমাত্র সেই ব্যক্তিকে বাদ দিয়ে যিনি আমার কোন কিছু জানার বিষয়েই সন্দেহ প্রকাশ করতে পারেন। তবুও এই সমস্ত কিছুকে সঙ্গতভাবেই সন্দেহ করা যেতে পারে এবং সমস্ত বিষয়গুলোই সম্যক গুরুত্ব সহকারে আলোচনার অপেক্ষা রাখে, যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা নিশ্চিত হচ্ছি যে আমরা বিষয়গুলোকে যেভাবে প্রকাশ করতে চাইছি তা সম্পূর্ণ সত্য।
এই অসুবিধাগুলো সহজ ভাষায় প্রকাশ করার জন্য, আসুন আমরা টেবিলেই মনঃসংযোগ করি। দৃষ্টি-ইন্দ্রিয়ে এটি আয়তাকার, বাদামি রঙের এবং উজ্জ্বল বর্ণের, স্পর্শেন্দ্রিয়ে এটি মসৃণ, শীতল ও কঠিন। টোকা দিলে কাঠের আওয়াজ পাই আমি। কোন ব্যক্তি, যে টেবিলটি দেখছে, অনুভব করছে এবং শব্দ শুনছে, সে-ও এই বর্ণনার সাথে একমত হবে। সুতরাং এর থেকে মনে হবে পারে এই বর্ণনায় কোনরূপ মতবিরোধ হবার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু যেইমাত্র আমরা একটু নিখুঁত বর্ণনা দেবার চেষ্টা করতে যাব, তখনই গন্ডগোলের সূত্রপাত হবে। সম্পূর্ণ টেবিলটা প্রকৃতই একই রঙের বলে যদিও আমি বিশ্বাস করি, তবুও যে অংশটায় আলো পড়ে প্রতিফলিত হচ্ছে সেটা অন্য অংশের চেয়ে উজ্জ্বলতর এবং কিছু অংশ আলোর প্রতিফলনের কারণে বেশ সাদাই লাগছে। আমি যদি স্থান পরিবর্তন করি তাহলে আলোর প্রতিফলিত অংশটিও সরে যাবে এবং টেবিলের রঙের আপাত-সৃষ্ট সমতা পরিবর্তিত হবে। এর থেকে প্রতিপন্ন হয় যে বেশ কয়েকজন ব্যক্তি যদি একই মুহূর্তে টেবিলের দিকে তাকায় তবে তাদের কেউই টেবিলের রঙের তারতম্য একই রকম দেখবে না, কেননা তারা কেউই একই দৃষ্টিকোণ থেকে টেবিলটা দেখছে না–দৃষ্টিকোণের যে-কোন পরিবর্তন প্রতিফলিত আলোর অংশের তারতম্য ঘটায়।
ব্যবহারিক ক্ষেত্রের বেশির ভাগ জায়গায় এসব পার্থক্যগুলো অপ্রয়োজনীয় মনে হতে পারে, কিন্তু চিত্রকরদের কাছে বিষয়টা অতীব প্রয়োজনীয়। একটা জিনিসের যে রঙ থাকা উচিত বলে মনে হয়, যাকে সাধারণ মানুষ সেই জিনিসের রঙ বলে মনে করে, একজন চিত্রকরকে সেভাবে দেখার অভ্যাস ভুলতে হয় এবং জিনিসটা দৃশ্যত বা বাস্তবে কিভাবে প্রতিভাত হচ্ছে তা দেখা রপ্ত করতে হয়। ইতিমধ্যেই আমরা এখানে সেই পার্থক্যগুলোর একটার শুরুতে চলে গিয়েছি যা দর্শনে গভীরতম বিরোধ সৃষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়ায় দৃশ্যমান এবং প্রকৃত সত্তা-র পার্থক্য বিষয়টি যা দেখায় (মনে হয়) এবং প্রকৃতই সে যা। চিত্রকর জানতে চায় বিষয়টি দৃশ্যত কেমন দেখাচ্ছে, একজন বাস্তববোধযুক্ত মানুষ এবং দার্শনিক জানতে চাইবে বস্তুত জিনিসটা কি। যেহেতু দার্শনিকের জানার ইচ্ছে বাস্তববোধযুক্ত মানুষটির চেয়ে বেশি, সে কারণে জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রের মতো জিজ্ঞাসার উত্তর দেওয়াও অনেক বেশি দুরূহ।
টেবিলের প্রশ্নে ফিরে যাওয়া যাক। উপরের আলোচনার ভিত্তিতে এটা পরিষ্কার যে এমন কোন রঙ নেই যা পূর্বের থেকে টেবিলের রঙ বলে বা টেবিলের কোন বিশেষ অংশের রং বলে পরিচিত। দৃশ্যগতভাবে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিভিন্ন রঙ পাওয়া যাচ্ছে এবং এটা মনে করার কোন কারণ নেই যে অন্যদের তুলনায় এদরে মধ্যে কোন কোন রঙ টেবিলের প্রকৃত রঙ। এমনকি এটাও আমরা জানি যে-কোন একটি উপরস্থাপিত দৃষ্টিকোণ থেকে এই রঙ আলাদা দেখাবে, একজন বর্ণান্ধ মানুষের কাছে বা কৃত্রিম আলোতে অথবা নীলচশমা পরিহিত কোন ভদ্রলোকের কাছে, আবার অন্ধকারে কোন রঙই থাকবে না, যদিও স্পর্শে ও শব্দে টেবিলটি অভিন্ন থাকবে। এই রঙটি এমন কিছু নয় যা টেবিলের সহজাত, বরং এমন কিছু যা টেবিল, দর্শক এবং টেবিলের আলোর প্রতিফলনের উপর নির্ভর করে। যখন আমরা প্রাত্যহিক জীবনে টেবিলের রঙের কথা বলি, তখন তার দ্বারা আমরা সেই রঙকে বোঝাই যা একজন সাধারণ মানুষ দৃষ্টিকোণ থেকে স্বাভাবিক আলোতে দেখে। কিন্তু অন্যান্য রঙ যা অন্যান্য শর্তসাপেক্ষ, তারাও প্রকৃত বলে দাবি করতে পারে। সুতরাং কোন পক্ষে না গিয়ে আমরা একথা বলতে বাধ্য হচ্ছি যে প্রকৃতপক্ষে টেবিলটির কোন একটি বিশেষ রঙ নেই।
এই একই কথা টেবিলের বহিরাবরণ সম্পর্কেও বলা যায়। খালি চোখে আমরা কাছের বিন্যাস কেউ দেখতে পাই, তা না হলে টেবিলটি মসৃণ এবং সমান। যদি আমরা অণুবীক্ষণযন্ত্রের সাহায্যে দেখি তাহলে এর অমসৃণতা ও বিভিন্ন উঁচু-নিচু অংশ এবং অন্যান্য বিষয় দেখতে পাবো যা খালি চোখে দেখা যায় না। এদের মধ্যে কোনটি প্রকৃত টেবিল? স্বাভাবিকভাবে আমরা বলবো, অণুবীক্ষণযন্ত্রের সাহায্যে যা আমরা দেখছি তা-ই প্রকৃত টেবিল। কিন্তু এই মত আবার বেশি শক্তিশালী অণুবীক্ষণযন্ত্রের সাহায্যে দেখার পর পাল্টে যাবে।
তাহলে, যদি আমরা খালি চোখে যা দেখি তার উপর বিশ্বাস রাখতে না পারি, তাহলে কেনই বা যা আমরা অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে দেখছি, তার উপরে বিশ্বাস রাখবো?
এভাবে ইন্দ্রিয়ের বিশ্বাসযোগ্যতা, যা দিয়ে আমরা শুরু করেছিলাম, তা আমরা বজায় রাখতে পারছি না।
টেবিলের আকারও কোন আশা দিচ্ছে না। আমরা প্রত্যেকে বিষয়ের প্রকৃত আকার নিয়ে বিচার করতেই অভ্যস্ত এবং আমরা চিন্তা না করেই এটা করে থাকি আর ভাবি যে আমরা বিয়য়ের প্রকৃত রূপ দেখছি। কিন্তু আসলে যদি আমরা আঁকতে চাই তাহলে যে-রকম আমাদের শিখতে হয়, ঠিক সে রকমই একটি বিষয়েকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিভিন্ন আকারের দেখায়। যদি আমাদের টেবিলটি সত্যিই আয়তাকার হয়, তাহলে প্রায় সব দৃষ্টিকোণ থেকে মনে হবে যে এটির যেন দুটি তীক্ষ্ণ কোণ এবং দুটি স্কুল কোণ আছে, যদি বিপরীত দিকগুলো সমান হয় তাহলে মনে হবে যেন দর্শকের দিক থেকে সরে এসে তারা মিলিত হয়েছে কোন একটি দিকে। যদি তারা সমান দৈর্ঘ্যের হয় তাহলে মনে হবে যেন কাছের দিকটি বেশি লম্বা। সাধারণভাবে টেবিলকে দেখলে এই সমস্ত দিকগুলো। বোঝা যায় না, কেননা অভিজ্ঞতা আমাদের দৃশ্যত আকারের থেকে প্রকৃত আকার গড়তে শেখায় এবং এই প্রকৃত আকারই সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করে। কিন্তু আমরা যা দেখি তা সর্বদা প্রকৃত আকার নয় এবং এটা হল যা দেখা হয় তার থেকে অনুমান করা। আমরা যা দেখি তা আকারের দিক থেকে পাল্টাচ্ছে যখনই আমরা ঘরে ঘুরে বেড়াচ্ছি। এই কারণে এখানে আমাদের ইন্দ্রিয় টেবিলের যথাযথ রূপ সম্বন্ধে সত্যতা ব্যক্ত করছে না, শুধুই টেবিলের দৃশ্যগত সত্যতা দিচ্ছে।
একই ধরনের অসুবিধার সৃষ্টি হয় যখন আমরা টেবিলের স্পর্শ নিয়ে আলোচনা করি। এটা সত্যি যে টেবিলটি সবসময় আমাদের একটা শক্ত কিছুর অনুভূতি দেয় এবং আমরা অনুভব করি এটি চাপদানে বাধা দেয়। কিন্তু যে অনুভুতি আমরা পাচ্ছি তা নির্ভর করে কতটা জোরে আমরা টেবিলে চাপ দিচ্ছি এবং শরীরের কোন অংশ দিয়ে চাপ দিচ্ছি তার উপর। এভাবে বিভিন্ন অনুভূতিগুলো বিভিন্ন চাপের দ্বারা বা শরীরের বিভিন্ন অংশের দ্বারা অনুভূত হয়ে কখনই সরাসারিভাবে টেবিলের কোন নির্দিষ্ট গুণাবলি ব্যক্ত করতে পারে না, যা পারে তাহল কতকগুলো গুণাবলির প্রতীক জানাতে যা হয়তো অনুভূতিগুলোর কারণ, কিন্তু যা প্রকৃতই তাদের মধ্যে পরিলক্ষিত হয় না। এই সবই শব্দের ক্ষেত্রে আরও বেশি সুস্পষ্ট, যা টেবিলে শব্দ করে প্রমাণ করা যায়।
তাহলে এটা পরিষ্কার যে প্রকৃত টেবিল, যদি আদৌ তা থাকে, সেটি তা নয় যা আমরা দেখা, স্পর্শ করা বা শোনার অভিজ্ঞতায় জানি। প্রকৃত টেবিল, যদি আদৌ তা থাকে, তা তাৎক্ষণিকভাবে আমরা জানতে পারি না, অনুমানের মাধ্যমে জানি। এ থেকে দুটি কঠিন প্রশ্ন জাগে : ১. সত্যিই কি কোন প্রকৃত টেবিল আছে? ২. যদি থাকে তাহলে সেটি কি ধরনের বস্তু?
এই প্রশ্নগুলো বুঝার জন্য আমরা কতকগুলো পদ ব্যবহার করতে পারি যার অর্থ সুনির্দিষ্ট ও পরিষ্কার। আসুন আমরা ইন্দ্রিয়-উপাত্ত নাম দিই সেসব বস্তুকে যা সংবেদনে তাৎক্ষণিকভাবে পাওয়া যায়, যেমন রঙ, শব্দ, গন্ধ, কঠোরতা, রুক্ষতা ইত্যাদি। বিষয়বস্তু সম্পর্কে তাৎক্ষণিক সচেতনতাকে আমরা সংবেদন আখ্যা দিতে পারি। এভাবে যখনই আমরা রঙ দেখি, তখনই আমাদের রঙের সংবেদন হয়, কিন্তু রঙটি নিজে হল একটি ইন্দ্রিয়-উপাত্ত, সংবেদন নয়। রঙটি হল সেই বিষয় যার সম্পর্কে আমরা তাৎক্ষণিকভাবে সচেতন হই এবং এই সচেতনতা নিজেই একটি সংবেদন। এটা স্পষ্ট যে যদি আমরা টেবিল সম্পর্কে কিছু জানতে চাই তাহলে আমাদের ইন্দ্রিয়-উপাত্তের সাহায্যেই জানতে হবে, যেমন বাদামি রঙ, আয়তাকার গঠন, মসৃণতা ইত্যাদি, যেগুলোকে আমরা টেবিলের সঙ্গে যুক্ত করে থাকি, কিন্তু যে সমস্ত কারণ দেয়া হয়েছে তার ভিত্তিতে আমরা একথা বলতে পারি না যে টেবিলটি হল একটি ইন্দিয়-উপাত্ত বা ইন্দ্রিয়-উপাত্ত হল টেবিলের প্রত্যক্ষ গুণাবলি। এভাবে আরও একটি সমস্যা তৈরি হচ্ছে ইন্দ্রিয়-উপাত্তের সঙ্গে টেবিলের সম্পর্ক যদি আমরা ধরে নিই এরকম কিছু আছে।
প্রকৃত টেবিল বলে যদি কিছু থাকে তাহলে তাকে আমরা বাহ্য বস্তু নাম দিতে পারি। এভাবে আমাদে ইন্দ্রিয়-উপত্তের সঙ্গে বাহ্য বস্তুর সম্বন্ধে বিবেচনা করতে হবে। সমস্ত বাহ্য বস্তুর একত্রীকরণেকে জড় বলা হয়। আমাদের দুটি প্রশ্নকে পুনরায় উপস্থাপন করা যায় এভাবে–১. জড় পদার্থ বলে কোন কিছু আছে কি? ২. যদি থাকে, তাহলে তার আকার কি?
যে দার্শনিক প্রথম সুস্পষ্টভাবে ইন্দ্রিয়ের দ্বারা উপস্থিত তাৎক্ষণিক বিষয়গুলোর স্বাধীন অস্তিত্ব আমাদের কাছে নেই বলে কারণ দেখান, তিনি হলেন বিশপ বার্কলে (১৬৮৫-১৭৫৩) তাঁর সন্দেহবাদী ও নিরীশ্বরবাদীদের বিরুদ্ধে হাইলাস ও ফিলোনাসের মধ্যে তিনটি কথোপকথন নামক গ্রন্থে তিনি প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে জড় বস্তু বলে কিছু নেই এবং জগতে শুধুমাত্র মন ও ধারণার অস্তিত্ব রয়েছে। জড়বস্তুতে বিশ্বাস করতেন, কিন্তু তাঁর সঙ্গে ফিলোনাসের কোন তুলনা হয় না। যে ক্ষমাহীনভাবে পরস্পরবিরোধী এবং আপাত-বিরোধী সত্যের দিকে ঠেলে দিয়েছে এবং নিজের জড়বস্তু অস্বীকারকে শেষে এমনভাবে উপস্থাপন করেছে যেন মনে হয় এটাই স্বাভাবিক। সেখানে দেওয়া যুক্তিগুলোর বিভিন্ন মাত্রা রয়েছে, কিছু গুরুত্বপূর্ণ এবং নিশ্চিত, কিছু গোলামেলে বা বাকচাতুরিপূর্ণ। কিন্তু বার্কলে তার দক্ষতা এমনভাবে প্রকাশ করেছেন যে তার জড়বস্তুর অস্বীকারকেঅস্বাভাবিক বলে মনে হয় না এবং যদি এমন কোন কিছু থাকে যা ব্যক্তি ছাড়া স্বাধীনভাবে থাকতে পারে, তা কখনই আমাদের তাৎক্ষণিক সংবেদনের বিষয় হতে পারে না।
যখন আমরা জড়বস্তুর অস্তিত্ব সম্পর্কে প্রশ্ন করি তখনই দুটি প্রশ্ন জড়িয়ে পড়ে এবং এই দুটি প্রশ্নকে আলাদা রাখা প্রয়োজন। সাধারণত জড় বলতে আমরা মনের বিপরীত বুঝে থাকি, এমন কিছু যা নিজ জায়গা নিয়ে থাকে এবং যাতে কোন চিন্তা বা চেতনা নেই। প্রধানত এই অর্থেই বার্কলে জডুকে অস্বীকার করেছেন। বলতে গেলে ইন্দ্রিয়-উপাত্ত, যা টেবিলের অস্তিত্ব সম্পর্কে প্রমাণ দেয়, যা আমাদের থেকে স্বাধীনভাবে আছে, তাকে তিনি অস্বীকার করেননি, তিনি আসলে এগুলোর অ-জড় হওয়াকে, এগুলো যে মন বা মনের দ্বারা কৃত কোন ধারণা, তাকেই অস্বীকার করেছেন। তিনি স্বীকার করেছেন যে যদি আমরা স্বর থেকে চলে যাই বা চোখ বন্ধ করে থাকি তাহলেও কিছুর অস্তিত্ব অবশ্যই থাকবে এবং আমরা যাকে টেবিল বলে জানি তার স্বপক্ষে অবশ্যই কিছু কারণ উপস্থাপন করা যাবে, যার দ্বারা আমরা বিশ্বাস করতে পারবো যে আমরা না দেখলেও কোন কিছু অবশ্যই থাকবে। কিন্তু তিনি বিশ্বাস করেন যে এই বস্তুটি প্রকৃতিগতভাবে যা আমরা দেখি তার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হতে পারে না এবং স্বাধীনভাবে থাকতে পারে না, যদিও এই বস্তুটি অবশ্যই আমাদের দেখার থেকে স্বাধীনভাবে আছে। এভাবে তিনি এই ধারণায় উপনীত হন যে প্রকৃত টেবিলটি ঈশ্বরের মনের এক ধারণা মাত্র। এই ধারণার স্বাধীনতা ও চিরস্থায়িত্ব রয়েছে। অবশ্যই জড়ের ধারণা যা জানা যায় না শুধুমাত্র আমরা অনুমান করতে পারি, কিন্তু কখনই সোজাসোজি ও তাৎক্ষণিকভাবে জানতে পারি না।
বার্কলের পর অন্যান্য দার্শনিকরা এই অভিমত পোষণ করেন যে যদিও টেবিলটি তার অস্তিত্বের জন্য আমাদের উপর নির্ভর করে না, কিন্তু এর অস্তিত্ব কোন মনের উপর নির্ভর করে যদিও এটা আবশ্যিকভাবে ঈশ্বরের ধারণা না-ও হতে পারে কিন্তু বিশ্বের সমস্ত মনের একত্রীকরণের উপর নির্ভর করে।
এই ধারণা তাঁরা পোষণ করেন বার্কলের মতন প্রধানত এই কারণে, কেননা তারা মনে করেন কোন কিছুর সত্তা বা কোন কিছুকে সত্য বলে জানা যায় না শুধুমাত্র মন এবং তার চিন্তা ও অনুভূতি ছাড়া। যে যুক্তির মাধ্যমে তারা এই মত সমর্থন করেন তাকে আমরা এভাবে ব্যক্ত করতে পারি :
যা কিছু ভাবা যায় তা হল ব্যক্তির মনের ধারণা যা সে চিন্তা করে, সুতরাং মনের ধারণা ছাড়া আর কিছু চিন্তা করা যায় না। সুতরাং অন্য সবকিছু হল অভাবনীয় এবং যা কিছু অভাবনীয় তার কোন অস্তিত্ব থাকতে পারে না।
আমার মতে এ ধরনের যুক্তি ত্রুটিপূর্ণ এবং এই মত পোষণ করেন তারা এই মতকে কিছুতেই এত সংক্ষেপে বা এত স্থূলভাবে উপস্থাপন করবেন না। কিন্তু সত্য হোক বা না-ই হোক, এই যুক্তিটি কোন-না-কোন আকারে প্রদর্শিত হয়ে থাকে এবং অনেক দার্শনিক, হয়তো বা বেশিরভাগই মনে করেন যে মন এবং তার ধারণা ছাড়া আর কোন কিছুই সত্য নয়। এই সমস্ত দার্শনিকরা ভাববাদী বলে পরিচিত। যখনই তাঁরা জড়কে ব্যাখ্যা করতে চান, তখনই তারা হয় বার্কলের মতো বলেন যে জড় হলো আসলে কতকগুলো ধারণার সমষ্টি, নয়তো লাইবনিজের (১৬৪৬-১৭১৬) মতো বলেন যে জড় বলে যা প্রতিভাত হয় তা আসলে কতকগুলো মৌলিক মনের সমষ্টি মাত্র।
কিন্তু এই দার্শনিকরা মনের বিপরীত জড়কে অস্বীকার করলেও অন্য আরেক অর্থে জড়কে স্বীকার করেন। এটা আমাদের মনে থাকা উচিত যে আমরা দুটি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেছিলাম–১. প্রকৃত টেবিল বলে কিছু আছে কি? ২. যদি থাকে তাহরে সেটি কি ধরনের বস্তু? এখন বার্কলে এবং লাইবনিজ এই দুজনেই মনে করেন যে প্রকৃত টেবিল আছে, কিন্তু বার্কলে বলেন এটি হলো নিজের মনের কিছু ধারণা এবং লাইবনিজ বলেন এটি আত্মার বাসগৃহ (Colony) সুতরাং এঁরা দুজনেই প্রথম প্রশ্নটির সার্থক উত্তর দেন এবং সাধারণ মানুষের মতো থেকে দ্বিতীয় প্রশ্নটির উত্তরের সময় মতপার্থক্য দেখান। সত্যি বলতে কি, প্রায় সমস্ত দার্শনিকরা এই বিষয়ে একমত যে প্রকৃত টেবিল আছে, তারা প্রায় প্রত্যেকেই একমত যে যদিও আমাদের ইন্দ্রিয়-উপাত্ত-রঙ, আকারে মসৃণতা ইত্যাদি আমাদের উপর নির্ভর করে, তা সত্ত্বেও তাদের প্রত্যক্ষীভূত হওয়া হলো এমন একটি প্রমাণ যা দেখায় যে কিছু বস্তু আমাদের থেকে স্বাধীনভাবে অস্তিত্বশীল, হয়তো তারা আমাদের ইন্দ্রিয়-উপাত্তের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এবং সেই ইন্দ্রিয় উপাত্তগুলোর কারণ হল আমাদের প্রকৃত টেবিলের সংযোগে আসা।
এখন স্বভাবতই এই সিদ্ধান্ত, যাকে সমস্ত দার্শনিকরা একমত যে প্রকৃত টেবিল আছে, তার স্বরূপ যাই হোক–তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। টেবিলের প্রকৃত স্বরূপ নিয়ে পুনরায় প্রশ্ন তোলার আগে এটা খুবই প্রয়োজনীয় বিবেচনার বিষয় যে এই ধরনের মত গ্রহণ করার কারণ কি। সুতরাং আমাদের পরবর্তী অধ্যায়ে আমরা সেই কারণগুলো দেখাব যার সাহায্যে মনে করা হয় যে প্রকৃত টেবিল আছে।
আরও বিশদভাবে আলোচনার আগে বিবেচনা করা দরকার যে যা আমরা এতক্ষণ ধরে আবিষ্কার করলাম সেই বিষয়টি কি। এটা মনে হয় যে যদি আমরা কোন সাধারণ বিষয়কে, যা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য, গ্রহণ করি, তাহলে ইন্দ্রিয় আমাদের তাৎক্ষণিকভাবে সেই বিষয় সম্পর্কে, যা আমাদের থেকে আলাদা, কিছু জানায় না, শুধুই ইন্দ্রিয়-উপাত্ত সম্পর্কে কিছু সত্য জানায় যা, যতদূর আমরা দেখেছি, বিষয় এবং আমাদের সম্পর্কের উপর নির্ভর করে। সুতরাং যা আমরা সরাসারি দেখি এবং অনুভব করি তা হল দৃশ্যমান সত্তা যা প্রকৃত সত্তার প্রতিচ্ছবি। কিন্তু যদি প্রকৃত সত্তা কখনও দৃশ্যমান না হয় তাহলে আমাদের জানার কি কোন উপায় থাকবে যে প্রকৃত সত্তা বলে কিছু আছে কিনা? তাই যদি হয় তাহলে আমাদের জানার কোন উপায় আছে কি যে বিষয়টি কি? এই সমস্ত প্রশ্নগুলো রীতিমতো চমকিত করার মতন এবং এটা জানা খুবই কঠিন যে অদ্ভুত কল্পনাগুলো সত্য নাও হতে পারে। এভাবে আমাদের অতি পরিচিত টেবিল, যা আমাদের মনে পূর্বে কোন চিন্তা জাগরিত করেনি, এমন একটি সমস্যায় পরিণত হয়েছে যা নানা সম্ভাবনায় পরিপূর্ণ। একটা বিষয় আমরা জেনেছি যে বিষয়টিকে যা মনে হয় তা সে নয়। এই সাধারণ ফলটুকু ছাড়া, বিষয় সম্পর্কে আমাদের অনুমান করার রাস্তা খোলা রয়েছে। লাইবনিজ আমাদের জানিয়েছেন এটা আত্মার সমাহার। বার্কলে জানিয়েছেন যে সবই হল ঈশ্বরের মনের ধারণা। বিজ্ঞানের মতে এ হলো বৈদ্যুতিক তরঙ্গ যা নাকি প্রচণ্ড গতিবেগে আলোড়িত হচ্ছে।
এ সমস্ত বিস্ময়কর সম্ভাবনার মধ্যে সন্দেহ জাগে যে হয়তো কোন টেবিলই নেই। দর্শন, যদি এটি এতসব প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারে যা জানতে আমরা চাই, অন্তত প্রশ্ন করার ক্ষমতা রাখে যা পৃথিবী সম্বন্ধে কৌতূহল জাগায় এবং দেখায় যে অতি সাধারণ বিষয়গুলো যা দৈনন্দিন জীবনের রয়েছে তার মধ্যে বিস্ময় এবং অত্যাশ্চর্যতা (বিচিত্রতা) রয়েছে।
২. জড়ের অস্তিত্ব
এই অধ্যায়ে আমাদের জিজ্ঞাসা জড়ের কোন-না-কোনভাবে অস্তিত্ব আছে কিনা।
এরকম কোন টেবিল আছে কি যা অন্তর্নিহিত স্বভাব রয়েছে এবং আমি টেবিলের দিকে না তাকালেও যার অস্তিত্ব থাকবে, নাকি টেবিলটি শুধুই আমার কল্পনার বস্তু মাত্র, আমার এক দীর্ঘায়িত স্বপ্নের ভেতর একটি স্বপ্ন-টেবিল?
এই প্রশ্নটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
কেননা যদি আমরা বস্তুর স্বাধীন সম্পর্কে নিশ্চিত হতে না পারি তাহলে আমরা অন্যের দেহের অস্তিত্ব সম্পর্কেও নিশ্চিত হতে পারবো না, এবং সেক্ষেত্রে অন্যের মনের সম্পর্কে আরও কম নিশ্চিত হবো, কেননা তাদের মনের অস্তিত্ব সম্পর্কে বিশ্বাস করার কোন ক্ষেত্রই থাকবে না আমাদের, শুধুমাত্র তাদের দেহ অবলোকন করা ছাড়া। এভাবে যদি আমরা বস্তুর স্বাধীনসত্ত সম্পর্কে নিশ্চিত হতে না পারি, তাহলে আমরা মরুভূমিতে সম্পূর্ণ একা হয়ে পড়বো এরকম হয়তো হবে যে সমস্ত বাইরের পৃথিবী স্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই নস্ত্র এবং আমরা শুধুমাত্র রয়েছি। এটি একটি অসুবিধাজনক সম্ভাবনা, কিন্তু এই সম্ভাবনাকে সম্পূর্ণভাবে মিথ্যা বলে প্রমাণিত কব্রা না গেলেও একে সত্য মনে করারও কোন কারণ নেই। এই অধ্যায়ে এই রকম অবস্থা কেন হয়, তা আমরা পর্যালোচনা করবো।
সন্দেহজনক বিষয়ের অবতারণা করার আগে, আসুন আমরা কোন একটি অপেক্ষাকৃত নিশ্চিত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে শুরু করি। টেবিলের অস্তিত্ব সম্পর্কে আমরা সন্দিহান হলেও টেবিলের ইন্দ্রিয়-উপাত্ত, যার মাধ্যমে আমরা টেবিলকে চিন্তা করি, সে সম্পর্কে আমরা কোন সন্দেহ করছি না। আমরা সন্দেহ করছি না যে যখন আমরা দেখি তখন কোন একটি বর্ণ বা আকার আমাদের সামনে আসে, যখন আমরা ধাক্কা মারি তখন কঠোর কোন কিছুর অস্তিত্ব আমাদের সকলের অনুভূত হয়। এই সমস্ত মানসিক বিষয় সম্পর্কে আমরা কোন প্রশ্ন তুলছি না। আসলে যা কিছুই সন্দেহজনক হোক না কেন, কোন কিছুকে অন্তত আমাদের তাৎক্ষণিক অভিজ্ঞতায় একেবারে নিশ্চিত বলে মনে হয়।
দেকার্ত (১৫৯৬-১৬৫০) আধুনিক পাশ্চাত্য দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা, একটি পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন যা এখনও ফলপ্রদভাবে ব্যবহার করা যায় প্রণালীবদ্ধ সন্দেহ পদ্ধতি। তিনি ঠিক করেছিলেন যে তিনি এমন কিছুকে সত্য বলে বিশ্বাস করবেন না যা তিনি সম্পূর্ণ পরিস্কার এবং স্বচ্ছভাবে দেখতে পারছেন না।
যা কিছুকে সন্দেহ করা যায় তাকে তিনি সন্দেহ করবেন, যতক্ষণ না এই সন্দেহ না করার পেছনে যুক্তি প্রদর্শন করা যাচ্ছে। এই পদ্ধতি প্রয়োগ করে তিনি ক্রমশ নিশ্চিত হলেন যে শুধুমাত্র নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কেই সম্পূর্ণ নিশ্চিত হওয়া যায়। তিনি কল্পনা করেছিলেন এমন এক প্রতারণাপূর্ণ দৈত্যকে যে তার ইন্দ্রিয়ের সামনে অসত্য বস্তুগুলোকে চির কল্পনার মত সাজিয়ে রেখেছে। এরকম দৈত্য থাকার সম্ভাবনা হয়তো নেই, কিন্তু তার এটা সম্ভব, সুতরাং ইন্দ্রিয়ের দ্বারা প্রত্যক্ষযোগ্য বস্তু সম্পর্কে সন্দেহ সম্ভব।
কিন্তু নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে সন্দেহ করা সম্ভব নয়, কেননা যদি তিনি অস্তিত্বশীল না হন তাহলে কোন দৈত্যই তাকে প্রতারিত করতে পারবে না। যদি তিনি সন্দেহ করেন, তাহলে তিনি অবশ্যই অস্তিত্ববান। যদি তার কোনরকম অভিজ্ঞতা হয়ে থাকে, তাহলে তিনি অবশ্যই অস্তিত্বশীল। সুতরাং তাঁর নিজের অস্তিত্ব তাঁর কাছে সম্পূর্ণ নিশ্চয়তার প্রতীক। তিনি বলেছিলেন, আমি চিন্তা করি, সুতরাং আমি আছি (Cogito, ergo sum) এবং এই নিশ্চয়তার উপর নির্ভর করেই তিনি তার জ্ঞানের জগৎ আবার গড়ে তুলেছিলেন যে জগৎ তার সন্দেহ ধ্বংস করে দিয়েছিল। সন্দেহের পদ্ধতি উদ্ভাবন করে এবং ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাই যে সবচেয়ে নিশ্চিত তা দেখিয়ে দেকার্ত দর্শনচর্চার ক্ষেত্রে বিরাট অবদান রেখেছিলেন এবং এই অবদান এখনও দর্শনের সমস্ত শিক্ষার্থী স্মরণ করে থাকে।
কিন্তু দেকার্তের এই যুক্তি আমি চিন্তা করি, সুতরাং আমিকে বিশেষ সতর্কতার সঙ্গে ব্যবহার করা প্রয়োজন, কেননা এই যুক্তি নিশ্চিত সত্যতা ছাড়া আরও কিছু বলছে।
এটা মনে হতে পারে যে আমাদের এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে গতকালের আমরা এবং আজকের আমরা একই ব্যক্তি এবং এটা কোন অর্থে সত্য। কিন্তু প্রকৃত টেবিলের মত প্রকৃত আত্মায় উপনীত হওয়া কঠিন এবং সেই নিশ্চিত সত্যতা এতে থাকছে না যা বিশেষ অভিজ্ঞতায় থাকে। যখন আমি আমার টেবিলের দিকে তাকাই এবং কোন বিশেষ বাদামি রঙ দেখি, তখন তাৎক্ষণিকভাবে একটা নিশ্চিত নয় যে আমি বাদামি রঙ দেখছি, বরং, একটি বাদামি রঙ দেখা হচ্ছে। এর মধ্যে অবশ্যই কোন কিছু বা কেউ জড়িত রয়েছে, যা বা যে এই বাদমি রঙ দেখছে। কিন্তু এর মধ্যে কোনভাবেই স্থায়ী ব্যক্তি নেই যাকে আমরা আমি বলতে পারি। তাৎক্ষণিক নিশ্চয়তা অনুযায়ী এটা সম্ভব যে যা বাদামি রঙ দেখছে তা হয়তো মুহূর্তে স্থায়ী এবং তা সেই বস্তু নয় যার পরবর্তী মুহূর্তে অন্য অভিজ্ঞতা হচ্ছে।
এভাবে আমাদের বিশেষ চিন্তা ও অনুভূতিরই আদি নিশ্চয়তা রয়েছে এবং এটা স্বাভাবিকভাবে দেখা সব স্বপ্ন ও প্রমাদেও প্রয়োগ করা যায়। যখন আমরা স্বপ্ন বা ভূত দেখি, তখন আমাদের নিশ্চিতভাবে সেই অনুভূতি হয় যা আমরা চিন্তা করি আমাদের হচ্ছে, কিন্তু বিভিন্ন কারণবশত মনে করা হয় যে এসব ইন্দ্রিয়-অনুভূতির সঙ্গে বাস্তবিক বস্তুর কোন মিল নেই। সুতরাং আমাদের জ্ঞানের অভিজ্ঞতার নিশ্চয়তাকে কোন বিশেষ ঘটনার জন্য কোনভাবে বাধাপ্রাপ্ত করা উচিত নয়। এভাবে আমরা একটি দৃঢ় ভিত্তিতে উপনীত হয়েছি যেখান থেকে আমরা জ্ঞানের অন্বেষণ শুরু করতে পারি।
এই বিষয়টি আমাদের বিবেচনা করতে হবে। ধরে নেয়া যাক আমরা ইন্দ্রিয় উপাত্ত সম্পর্কে নিশ্চিত। আমাদের কি কোনও কারণ আছে এই উপাত্তগুলোকে কোন কিছুর অস্তিত্বের প্রতীক বলে মনে করার, যাকে বলে আমরা বাহ্য বস্তু বলতে পারি? যখন আমরা সমস্ত ইন্দ্রিয়-উপাত্ত সাজিয়ে দিই যা টেবিলের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে জড়িত, তখন আমরা কি টেবিলের সম্বন্ধে সব বলে দিই, নাকি আরও কিছু থাকে-আরও কিছু যা ইন্দ্রিয়-উপাত্ত নয়, আরও কিছু যা তখনও থাকবে যখন আমরা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাবো? সাধারণ জ্ঞান বিন্দ্বিধায় বলবে কিছু একটা আছে। যাকে আনা যায়, বিক্রি করা যায়, ঠেলা যায়, উপরে কাপড় ঢাকা দেয়া যায় এবং আরও অনেক কিছু করা যায়, তা কখনই শুধুমাত্র কতকগুলো ইন্দ্রিয়-উপাত্তের সমাবেশ হতে পারে না। যদি কাপড়টি টেবিলটিকে সম্পূর্ণভাবে ঢেকে ফেলে, তাহলে আমরা টেবিল থেকে কোন ইন্দ্রিয়-উপাত্ত পাব না। সুতরাং টেবিলটি যদি শুধুমাত্র ইন্দ্রিয়-উপাত্তের সমাহার হয় তাহলে টেবিলটির অস্তিত্ব বিলুপ্ত হবে এবং কাপড়টি শূণ্যে ঝুলতে থাকবে, সেই জায়গায় কোনও এক অদৃশ্য শক্তির দ্বারা অবস্থান করবে যেখানে পূর্বে টেবিলটি ছিল। পুরো ব্যাপারটিই সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য। কিন্তু যারা দার্শনিক হতে চান তাঁদের এই ধরনের অবিশ্বাস্যতায় ভয় পেয়ে চলবে না।
আমরা কেন ইন্দ্রিয়-উপাত্ত ছাড়া একটি স্থায়ী বাহ্য বস্তু চাই তার স্বপক্ষে একটি বড় যুক্তি হল এই যে, আমরা একই বস্তু বিভিন্ন ব্যক্তিদের জন্য চাই। যখন দশজন ব্যাক্তি একটি ডিনার-টেবিলে বসে, তখন এটা বললে খুবই অদ্ভুত শোনাবে যে তারা একই টেবিল-ঢাকনা দেখছে না এবং একই ছুরি-কাঁচি এবং একই চামচ-গ্লাস দেখছে না। কিন্তু ইন্দ্রিয়-উপাত্তগুলো প্রত্যেক আলাদা ব্যক্তির কাছে ব্যক্তিগত, যা তাৎক্ষণিকভাবে একজনের কাছে দৃশ্যগোচর তা আরেকজনের কাছে তাৎক্ষণিকভাবে দৃশ্যগোচর নয়। প্রত্যকেই বিষয়গুলোকে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখছে এবং ফলত বিষয়গুলোকে কিছুটা আলাদা দেখছে। এভাবে, যদি কোন নিরপেক্ষ সাধারণ বিষয় থাকতে হয় যা বিভিন্ন লোকের কাছে জানা, তাহলে ব্যক্তিগত এবং বিশেষ ইন্দ্রিয়-উপাত্তের বাইরে কিছু একটা থাকতে হবে যা বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে দৃশ্যমান হয়। এটি বিশ্বাস করার স্বপক্ষে কি যুক্তি আছে যে এ রকম সাধারণ নিরপেক্ষ কোনও বস্তু রয়েছে?
এর প্রথম যে উত্তর একজনের কাছে স্বাভাবিকভাবে আসে তা হলো-যদিও বিভিন্ন ব্যক্তি টেবিলটিকে কিছুটা আলাদাভাবে দেখছে, তা সত্ত্বেও তারা কোন না কোনভাবে একই বিষয় দেখছে টেবিলের দিকে তাকানোর সময় এবং তাদের দেখার পার্থক্যটা স্থানগত ও আলোর প্রতিফলনের সূত্রের জন্য হচ্ছে আর সমস্ত ইন্দ্রিয়-উপাত্তের নিচে একটি স্থায়ী টেবিলে আসা সহজ হচ্ছে।
আমি আমার টেবিলটি এই ঘরের পূর্বের বাসিন্দার কাছ থেকে কিনেছি, কিন্তু আমি তার ইন্দ্রিয়-উপাত্ত কিনতে পারিনি, যা তার যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অন্তর্হিত হয়েছে, কিন্তু আমি কিনতে সক্ষম হয়েছি এবং কিনেছি প্রায় এই ধরনের ইন্দ্রিয় উপাত্ত। সুতরাং এটা সত্য যে বিভিন্ন ব্যক্তির একই ইন্দ্রিয়-উপাত্ত রয়েছে এবং কোন এক ব্যক্তি কোন এক জায়গায় ভিন্ন ভিন্ন সময়ে এই ইন্দিয়-উপাত্তের অধিকারী যা আমাদের মনে করিতে সাহায্য করে যে ইন্দ্রিয়-উপাত্ত ছাড়াও স্থায়ী বাহ্য বস্তু রয়েছে যা সময়ের ইন্দ্রিয়-উপাত্তের কারণ।
এখন উপরিউক্ত আলোচনাটি নির্ভর করছে এর উপর যে আমরা ছাড়াও অন্যান্য ব্যক্তি রয়েছে।
অন্যান্য ব্যক্তি আমার কাছে উপস্থাপিত হয় নির্দিষ্ট ইন্দ্রিয়-উপাত্তের মাধ্যমে, যেমন তাদের দেখা বা তাদের গলার শব্দের দ্বারা এবং যদি আমার বিশ্বাস করার কোন কারণ না থাকে যে আমার ইন্দ্রিয়-উপাত্ত ছাড়া স্বাধীনভাবে বাহ্য বস্তুর অস্তিত্ব রয়েছে, সেক্ষেত্রে আমার এও বিশ্বাস করার কারণ থাকছে না যে অন্য ব্যক্তিদেরও অস্তিত্ব রয়েছে শুধুমাত্র আমার স্বপ্নের গন্ডি ছাড়া।
এভাবে যখন আমরা দেখাবার চেষ্টা করি যে আমাদের নিজেদের ইন্দ্রিয় উপাত্ত ছাড়াও বাহ্য বস্তুর স্বাধীন অস্তিত্ব রয়েছে, তখন আমরা অন্যের বিশ্বাসের সাক্ষ্যপ্রমাণের উপর নির্ভর করতে পারি না, যেহেতু এটিও ইন্দ্রিয় দ্বারা তৈরি এবং অন্যের অভিজ্ঞতাকে প্রকাশিত করতে পারছে না-যতক্ষণ পর্যন্ত এটা বলা না যাচ্ছে যে আমাদের নিজেরদের ইন্দ্রিয়-উপাত্ত স্বাধীন বাহ্য বস্তুর অস্তিত্বের প্রতিক মাত্র। সুতরাং সম্ভব হলে আমরা আমাদের নিজেদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার মধ্যে সেই লক্ষণগুলোকে খোঁজার চেষ্টা করবো যা দেখায় বা দেখানোর চেষ্টা করে যে জগতে আমরা এবং আমাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ছাড়াও বাহ্য বস্তু রয়েছে।
এটা অবশ্য স্বীকার্য যে এক অর্থে কখনই নিজেকে এবং নিজেদের অভিজ্ঞতার সাহায্য ছাড়া বাহ্য বস্তুর অস্তিত্ব প্রমাণ করতে পারবো না। কোন যৌক্তিক অসম্ভব এই প্রকল্প থেকে আসছে না যে এই জগৎ শুধু আমি এবং আমার চিন্তা, অনুভূতি ও ইন্দ্রিয়-অনুভূতি দিয়ে তৈরি এবং বাদবাকী সবকিছুই হল স্রেফ কল্পনা। স্বপ্নে কোন এক জটিল জগৎ উপস্থাপিত করা সম্ভব, জাগার পর যা নিছক কল্পনায় পরিণত হতে পারে। আমরা দেখছি স্বপ্নের ইন্দ্রিয় উপাত্তের সঙ্গে বাহ্য বস্তুর কোন মিল নেই, যা আমরা স্বাভাবিকভাকেই ইন্দ্রিয় উপাত্তের মাধ্যমে অনুমান করে থাকি (এটা সত্যি যে যখন বাহ্য জগৎ অনুমান করা হয়, তখন স্বপ্নের ইন্দ্রিয়-উপাত্তের বাহ্য কারণ সংগ্রহ করা সম্ভব, যেমন দরজার আওয়াজ আমাদের নৌ-ঘটিত চুক্তির স্বপ্নের কারণ হতে পারে। যদিও এই ক্ষেত্রে ইন্দ্রিয়-উপাত্তের বাহ্য কারণ রয়েছে, কিন্তু সত্যিকারের নৌ-যুদ্ধের সঙ্গে মিল রয়েছে এ রকম কোন ইন্দ্রিয়-উপাত্তের বাহ্য বস্তু খুঁজে পাওয়া যাবে না)।
এই ধরনের অনুমানে কোন যৌক্তিক অসুবিধা নেই যে আমাদের সমস্ত জীবন হল একটি স্বপ্ন, যেখানে আমরা নিজেরা সমস্ত বস্তু তৈরি করি যেগুলো আমাদের সামনে উপস্থাপিত হয়। এটা যুক্তিগতভাবে অসম্ভব না হলেও একে সত্যি মনে করার কোন কারণ নেই এবং এটা অনেক সহজ প্রকল্প যার মাধ্যমে আমরা নিজেদের জীবনের ঘটনাকে ব্যাখ্যা করতে পারি সাধাণের মতের থেকে, যেখানে ব্যাক্তি ছাড়া বাহ বস্তুর স্বতন্ত্র অস্তিত্ব স্বীকার করা হয় এবং যে বাহ্য বস্তু আমাদের ইন্দ্রিয়-অনুভূতির কারণ হয়।
বাহ্য বস্তুর অস্তিত্ব সত্যিই আছে বলে ধরে নিলে কিভাবে সহজতা আসে তা অনায়াসেই বোঝা যেতে পারে। যদি একটি বিড়াল ঘরের কোন এক অংশে কোন এক মুহূর্তে দেখা দেয় এবং অন্য মুহূর্তে অন্য অংশে, তাহলে এটা মনে করাই স্বাভাবিক যে বিড়ালটি এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় গিয়েছে, বিভিন্ন অবস্থান পেরিয়ে। কিন্তু যদি এটি শুধুমাত্র ইন্দিয়-উপাত্তের সমষ্টি হয় তাহলে সে সেই জায়গায় থাকতে পারবে না যেখানে আমি তাকে দেখিনি। সেক্ষেত্রে আমাদের মনে করতে হবে যে আমি যখন দেখছি না তখন বিড়ালটির অস্তিত্ব নেই, বরং হঠাৎ কোন নতুন জায়গায় গজিয়ে উঠেছে সে। আমার দেখা বা না দেখার উপর যদি বিড়ালটির অস্তিত্ব নির্ভর না করে, তাহলে আমরা আমাদের নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পারি একবার খাওয়া এবং তার পরের খাওয়ার মধ্যে কিভাবে সে ক্ষুধার্ত হয়ে পড়ছে, কিন্তু আমার না দেখার উপর যদি এর অস্তিত্ব নির্ভর করে তাহলে এটি অস্বাভাবিক যে তার অস্তিত্বশীল থাকার সময় মতোই দ্রুতগতিতে তার ক্ষুধা বেড়ে চলেছে। বিড়ালটি যদি শুধুমাত্র ইন্দ্রিয় উপাত্ত দ্বারা গঠিত হয় তাহলে সে ক্ষুধার্ত হতে পারে না, কেননা শুধুমাত্র আমার নিজের ক্ষুধা ছাড়া অন্য কোন ক্ষুধা আমার কাছে ইন্দ্রিয়-উপাত্ত হতে পারে না। সুতরাং যে ইন্দ্রিয়-উপাত্তের ব্যবহার আমার কাছে বিড়ালটিকে উপস্থাপিত করছে, তাকে ক্ষুধার প্রকাশ হিসেবে দেখা হলে খুবই স্বাভাবিক মনে হতে পারে, কিন্তু যখন তাকে শুধুমাত্র বর্ণ পরিবর্তন ও নিছক নড়াচড়া বলে গ্রহণ করা হয় যা নাকি ক্ষুধা প্রকাশে অসমর্থ, তখন তা সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য হয়ে পড়ে ঠিক যে রকম একটি ত্রিভুজ ফুটবল খেলতে অসমর্থ।
কিন্তু বিড়ালটির ক্ষেত্রে এই অসুবিধা মানুষের ক্ষেত্রের অসুবিধার তুলনায় কিছুই নয়। যখন মানুষেরা কথা বলে অর্থাৎ যখন আমরা কোন শব্দ শুনি যা আমরা ধারণার সঙ্গে পাই এবং একই সঙ্গে যখন আমরা ঠোঁটের নড়াচড়া এবং মুখের পরিবর্তন দেখি, তখন এটা ভাবা খুবই কষ্টকর যে আমরা যা শুনছি তা কোন চিন্তার অভিব্যক্তি নয়, যা ওই একই কথা উচ্চারিত হলে হওয়া উচিত বলেই আমরা জানি। অবশ্য এই একই ঘটনা স্বপ্নেও ঘটে যেখানে আমরা ভ্রমবশত অন্য ব্যক্তির অস্তিত্ব স্বীকার করি। কিন্তু স্বপ্ন সাধারণত জাগরিত অবস্থার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় এবং কোন না কোনভাবে এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেয়া সম্ভব যদি আমরা মনে করি যে বাহ্য জগতে সত্য আছে। এভাবে সমস্ত সহজতার সূত্র আমাদের এই প্রাকৃতিক মত গ্রহণ করতে বলে যে আমরা এবং আমাদের ইন্দ্রিয়-উপাত্ত ছাড়াও বাহ্য বস্তু সত্যই আছে এবং তাদের অস্তিত্ব আমাদের দেখার উপর নির্ভর করে না।
অবশ্য শুধুমাত্র যুক্তির দ্বারা আমরা স্বাধীন বাহ্য জগতে সত্য আছে এই বিশ্বাসে উপনীত হইনি। যখনই আমরা এই বিষয় নিয়ে চিন্তা করি, তখনই দেখি এই বিশ্বাস আমাদের ভিতরে রয়েছে। একে প্রবৃত্তিগত বিশ্বাস বলা যায়। আমরা এই বিশ্বাস সম্পর্কে কোন প্রশ্ন তুলি না শুধুমাত্র তখনই, যখন দেখার ক্ষেত্রে মনে হয় যেন ইন্দ্রিয়-উপাত্তটি নিজেই স্বাধীন বস্তু হিসেবে প্রবৃত্তিগতভাবে বিশ্বাস জাগায়, কিন্তু যুক্তি প্রমাণ করে যে বস্তুটি কখনও ইন্দ্রিয়-উপাত্ত হতে পারে না। এই আবিষ্কারটি, যেটি মোটেই স্বাদ, ঘ্রাণ এবং শব্দের ক্ষেত্রে বিভ্রান্তিকর নয়, শুধুমাত্র স্পর্শের ক্ষেত্রে সামান্য বিভ্রান্তিকর- আমাদের প্রবৃত্তিগত বিশ্বাসকে কমিয়ে দেয় যে ইন্দ্রিয়-উপাত্তের সঙ্গে বাহ্য বস্তু রয়েছে। যেহেতু এই বিশ্বাস কোন অসুবিধার সৃষ্টি করে না বরং আমাদের অভিজ্ঞতার আরও সরলীকরণ করতে সাহায্য করে, তাই একে অস্বীকার কার কোন যুক্তিগ্রাহ্য কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। সুতরাং আমরা স্বীকার করতে পারি যদিও স্বপ্নের থেকে পাওয়া ক্ষীণ সন্দেহ সমেত-যে বাহ্য জগত সত্যিই রয়েছে এবং এটি সম্পূর্ণভাবে আমাদের অনুভূতির উপর নির্ভরশীল নয়।
যে যুক্তির ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্তে আমরা উপনীত হয়েছি তা আমাদের কাঙ্কিত যুক্তির মতো ততটা জোরালো নয় ঠিকই, কিন্তু বহু দার্শনিক যুক্তির ক্ষেত্রেই তা সত্য এবং এ কারণে এটির সাধারণ চরিত্র ও সত্যতা সংক্ষেপে বিচার করা যায়। আমরা দেখেছি যে সমস্ত জ্ঞানকেই আমাদের প্রবৃত্তিগত বিশ্বাসের উপর গড়ে তোলা উচিত এবং যদি এদের বাতিল করা হয় তাহলে কিছুই থাকে না। কিন্তু আমাদের এই প্রবৃত্তিগত বিশ্বাসগুলোর মধ্যে কোনটি অন্যের থেকে বেশি শক্তিশালী, আবার কোনটি স্বভাব এবং সংযোগের জন্য অন্য বিশ্বাসের সঙ্গে জড়িত, যা প্রবৃত্তিগত নয়, কিন্তু যাকে ভ্রমবশত প্রবৃত্তিগত নয়, কিন্তু যাকে এমবশত প্রবৃত্তিতের অন্তর্গত বলে মনে করা হয়।
দর্শন আমাদের এই প্রবৃত্তিগত বিশ্বাসের উচ্চ নীচ শেখায়, তার শুরু সেই বিশ্বাসগুলো দিয়ে যা আমরা কাঠোরভাবে বিশ্বাস করি এবং প্রত্যেকটি বিশ্বাসকে আলাদাভাবে উপস্থাপিত করে ও অপ্রাসঙ্গিকতা হাত থেকে রক্ষা করে। এটি দেখায় কিভাবে এগুলো চূড়ান্তভাবে রয়েছে, যা আমাদের প্রবৃত্তিগত বিশ্বাসে দ্বন্দ্ব জাগায় না বরং একটি সুসামঞ্জস্য প্রণালীতে পরিণত করে। কোন একটি প্রবৃত্তিগত বিশ্বাস পরিত্যাগ করার স্বপক্ষে এরকম কোন কারণ থাকতে পারে না, শুধুমাত্র তখনই যখন এটি অন্যের সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হচ্ছে। এভাবে যদি এদের ঐক্যবদ্ধ দেখা যায় তাহলে সমস্ত প্রণালীটিই গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে।
এটা অবশ্য সম্ভব যে সমস্ত বা কোন একটি বিশ্বাস ভুল হতে পারে, এবং এই কারণে সবকিছুকেই একটু সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখা উচিত। কিন্তু যতক্ষণ না অন্য একটি বিশ্বাস আসে ততক্ষণ আমাদের কোন একটি বিশ্বাস পরিত্যাগ করা উচিত নয়।
সুতরাং আমাদের প্রবৃত্তিগত বিশ্বাস ও তাদের ফলাফলকে সুসংগঠিত করে, এদের মধ্যে কোনটি বিশ্বাসযোগ্য তা দেখে, যদি দরকার হয় পরিবর্তিত বা পরিত্যাগ করে, আমরা এই প্রবৃত্তিগত ভিত্তিতে সুসংহত জ্ঞানে পৌঁছতে পারি,
যেখানে ভুল হবার সম্ভাবনা থেকে গেলেও তার সম্ভাবনা কমিয়ে আনা যায় বিভিন্ন অংশের সংযোগের সাহায্যে এবং বিচারপূর্ণ আলোচনার সাহায্যে, নাকি পূর্বে ছিল। এই কাজটি অন্তত দর্শন করতে পারে। বেশির ভাগ দার্শনিক ঠিক বা ভুলভাবে বিশ্বাস করেন যে দর্শন এর থেকে বেশি কিছু করতে পারে, এটি আমাদের সামগ্রিকভাবে এই জগৎ সম্বন্ধে এবং সত্যের স্বভাব সম্বন্ধে জ্ঞান দিতে পারে, যা অন্যভাবে পাওয়া যায় না। এটি সঠিক কিনা তা বলা না গেলেও দর্শনের কাজ সম্বন্ধে আমরা যা বলেছি তা অবশ্যই দর্শন করতে পারে এবং এটা তাদের কাছে যথেষ্ট যারা একবার সাধারণ জ্ঞানের যথার্থতা সম্বন্ধে সংশয় প্রকাশ করেছেন এবং দার্শনিক সমস্যাগুলো যে যথেষ্ট কঠিন তাও মনে করেন।
৩. জড়ের প্রকৃতি
পূর্ববর্তী অধ্যায়ে আমরা সম্মত হয়েছি (যদিও প্রয়োগভিত্তিক যুক্তি ছাড়াই) যে এটি বিশ্বাস করা যুক্তিসম্মত যে আমাদের ইন্দ্রিয়-উপাত্ত-যেমন, সেই বিষয়গুলো যা আমরা আমার টেবিলের সঙ্গে যুক্ত করেছিলাম হল বিষয়ের অস্তিত্বের প্রতীক যা আমাদের প্রত্যক্ষ থেকে স্বাধীনভাবে অস্তিত্বশীল, অর্থাৎ বর্ণ, কাঠিন্য, শব্দ ইত্যাদির সংবেদন ছাড়াও যা টেবিলটিকে আমার কাছে দৃশ্যমান করে তোলে, আমি মনে করি যে আরও কিছু একটা আছে যার মধ্যে এই বিষয়গুলো দৃশ্যমান হয়। যখনই আমি চোখ বন্ধ করি তখনই বর্ণ অন্তর্হিত হয়, যখনই আমি আমার হাত টেবিল থেকে সরিয়ে নিই তখনই কাঠিন্যের সংবেদন অনহিত হয়, আমি শব্দ করা বন্ধ করলেই টেবিলের আওয়াজও বন্ধ হয়। কিন্তু আমি এটা বিশ্বাস করি না যে যখন সবকিছুই অন্তর্হিত হয় তখন টেবিলও অন্তর্হিত হয়। বরং আমি বিশ্বাস করি টেবিলটি সর্বক্ষণ অস্তিত্বশীল বলেই যখনই আমি চোখ খুলবো, আমার হাত রাখবো এবং আবার শব্দ করা আরম্ভ করবো, তখনই সমস্ত ইন্দ্রিয়-উপাত্ত আবার ফিরে আসবে। এই অধ্যায়ে যে প্রশ্নটি আমরা বিবেচনা করবো তা হলো-এই প্রকৃত টেবিলের প্রকৃতি কি, যা আমার প্রত্যেক ছাড়াই স্বাধীনভাবে আছে? পদার্থবিজ্ঞান এই প্রশ্নের এক অসম্পূর্ণ ও কিছুটা অনুমানমূলক উত্তর দিয়েছে, তথাপি তা যথেষ্ঠ শ্রদ্ধার রাখে দাবি। পদার্থবিজ্ঞান অনেকটা না জেনেই এই মতে উপনীত হয়েছে যে সমস্ত প্রাকৃতিক ঘটনাবলিকে গতিতে পরিণত করা উচিত। আলো, তাপ ও শব্দ সমস্তই তরঙ্গ-গতির ফল, যা বস্তুর থেকে নির্গত হয়ে সেই ব্যক্তির দিকে যায় যে সেই আলো দেখে বা উষ্ণাতা অনুভব করে বা শব্দ শোনে। যার এই তরঙ্গ-গতি রয়েছে তা হয় ইথার অথবা স্থল জড় পদার্থ, কিন্তু এই দুটি ক্ষেত্রেই দার্শনিক এর নাম দেবে জড়। বিজ্ঞান যে একমাত্র গুণাবলি এতে আরোপ করবে তা হল স্থান এবং গতিসূত্র অনুসারে গতিশক্তি। বিজ্ঞান এর অন্যান্য গুণাবলিকে অস্বীকার করছে না, কিন্তু যদি তাই হয়, এই সমস্ত গুণাবলি বৈজ্ঞানিকের কাছে প্রয়োজনীয় নয় এবং এগুলো ঘটনাবলি বিশ্লেষণ করতে তাঁকে সাহায্য করে না।
অনেকে বলেন আলো হল তরঙ্গ-গতি রূপ, কিন্তু এটি ভ্রান্ত, কেননা যে আলো আমরা তাৎক্ষণিকভাবে দেখি, যা আমরা ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে সরাসরি জানি, তা তরঙ্গ-গতির রূপের নয়। এ হল সম্পূর্ণ আলাদা এমন কিছু যা আমরা, দৃষ্টিহীন না হলে, সবাই জানি, যদিও আমরা তার বর্ণনা করতে পারবো না এবং আমাদের এই জ্ঞান একজন দৃষ্টিহীনকে দিতে পারবো না। অপরপক্ষে, একটি তরঙ্গ গতির একজন দৃষ্টিহীনের কাছে বর্ণনা করা যায়, কেননা সে তার স্পর্শের সাহায্যে স্থানের জ্ঞান লাভ করতে পারে এবং সমুদ্রে ভ্রমণের মাধ্যমে এই তরঙ্গ গতির ব্যাপারে আমাদের মতই অভিজ্ঞতা লাভ করতে পারে। কিন্তু একজন দৃষ্টিহীন ব্যক্তি এর সহায্যে যা জানে তাকে আমরা আরো বলে বুঝি না। আমরা আলো বলে বুঝি তাকেই যা একজন দৃষ্টিহীন ব্যক্তি কখনই বুঝতে পারবে না। এবং যাকে আমরা কোনদিনই তার কাছে বর্ণনা করতে পারবো না।
এখন এই এমন কিছু, যাকে একমাত্র দৃষ্টিহীনরা ছাড়া সকলেই জানে, তাকে বিজ্ঞানের নিয়ম অনুযায়ী বাইরের জগতে পাওয়া যাবে না। এটি হল এমন কিছু যা দ্রষ্টা ব্যাক্তির চোখ, স্নায়ু ও মস্তিষ্কের উপরে নির্দিষ্ট কিছু তরঙ্গের ক্রিয়ার ফল। যখন বলা হয় যে আলো হল তরঙ্গরাশি,তখন আসলে বোঝানো হয় যে তরঙ্গরশ্মিগুলো হল আমাদের আলোর সংবেদনের বাহ্য কারণ। কিন্তু যার মাধ্যমে সাধারণ ব্যক্তিরা অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে এবং দৃষ্টিহীনরা করে না, সেই আলোকে বিজ্ঞান জগতের কোন অংশ বলে মনে করে না, যা আমাদের এবং আমাদের ইন্দ্রিয়ের অস্তিত্ব-নিরপেক্ষ (স্বাধীন)। এই একই কথা অন্যান্য সংবেদনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
বিজ্ঞানের জগতে শুধুমাত্র বর্ণ, শব্দ ইতাদিই যে জড়ের মধ্যে নেই তা-ই নয়, স্থানেরও ঠাই নেই সেখানে, যাকে আমরা দেখা বা স্পর্শের মাধ্যমে অনুভব করি। বিজ্ঞানের কাছে প্রয়োজনীয় হল যে জড় কোন স্থান অধিকার করে থাববে, কিন্তু যে স্থানে এই জড় রয়েছে তা কিন্তু সেই স্থান নয় যা আমরা দেখি বা অনুভব করি। সূচনাপর্বে বলা যায়, যে স্থানকে আমরা দেখি তা সেই স্থান নয় যাকে আমরা স্পর্শের দ্বারা পাই। শৈশবের অভিজ্ঞতার সাহায্যে আমরা শিখি যা দেখছি তাকে কিভাবে ধরতে হয়, বা কিভাবে সেই দ্রব্যগুলো দেখা যায় যা আমরা স্পর্শ দিয়ে অনুভব করছি। কিন্তু বিজ্ঞানের মতে স্থান হচ্ছে স্পর্শ এবং দেখার মধ্যে নিরপেক্ষ, কাজেই এটি স্পর্শস্থানও নয় বা দৃষ্টিস্থানও নয়।
আবার, বিভিন্ন লোকেরা একই বস্তুকে তাদের দৃষ্টিকোণ অনুযায়ী বিভিন্ন আকারের দেখে। যেমন একটি গোল মুদ্রা। এটিকে আমাদের সর্বদা গোল বলাই উচিত হলেও মুদ্রাটির দিকে সোজাসুজি না তাকালে সেটিকে ডিম্বাকার দেখতে পারে। এটিকে গোল বলে বিচার করার সময়, আমরা বিচার করি যে এর একটি প্রকৃত আকার আছে যা এর দৃশ্যগত আকার নয়, বরং এর অন্তর্নিহিত স্বভাব যা দৃশ্যগত আকারের থেকে আলাদা। কিন্তু এই প্রকৃত আকার যা বিজ্ঞানের বিচার্য বিষয় তাকে অবশ্যই প্রকৃত স্থানে থাকতে হবে, যে-কোন ব্যক্তির আপাত স্থানে থাকলে চলবে না। প্রকৃত স্থান হল সর্বজনগ্রাহ্য, আপাত স্থান প্রত্যক্ষকর্তার ব্যক্তিগত। বিভিন্ন ব্যক্তির স্থানে একই বস্তুকে বিভিন্ন আকারে মনে হতে পারে। এভাবে প্রকৃত স্থান, যাতে প্রকৃত আকার রয়েছে, তা ব্যক্তিগত স্থানের থেকে আলাদা।
সুতরাং বিজ্ঞান যে স্থান নিয়ে আলোচনা করে তা আমরা যে-স্থান দেখি এবং অনুভব করি তার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হলেও এক নয় এবং এই সম্পর্ক আলোচনার অবকাশ রাখে। আমরা সম্মত হয়েছিলাম যে বাহ্য বস্তু আমাদের ইন্দ্রিয়-উপাত্তের সঙ্গে এক হতে পারে না, কিন্তু আমাদের সংবেদনের কারণ হতে পারে। এসব বাহ্য বস্তুগুলো বিজ্ঞানের স্থানে রয়েছে, যাদেরকে আমরা বাহ্যিক স্থান বলতে পারি। এটি গুরুত্বপূর্ণ যে আমাদের সংবেদনগুলো যদি বাহ্য বস্তু দ্বারা ঘটে থাকে তাহলে অবশ্যই বাহ্য স্থান থাকবে যেখানে এসব বস্তু, আমাদের ইন্দ্রিয়গুলো, স্নায়ু এবং মস্তিষ্ক রয়েছে। আমরা কোন একটি বস্তুর স্পর্শ সংবেদন তখনই পাই যখন আমরা তার সংযোগে আসি। অর্থাৎ যখন আমাদের দেহের কোন অংশ বাহ্য স্থানে থাকে সেই স্থানের কাছে যেখানে বস্তু জায়গা নিয়ে রয়েছে। আমরা একটি বস্তুকে দেখি যখন কোন অস্বচ্ছ বস্তু আমাদের চোখ ও কর মাঝখানে বাহ্য স্থানে থাকে না। একইভাবে আমরা শুধু শুনি বা ঘ্রাণ নিই বা বস্তুর স্বাদ আস্বাদন করি যখন আমরা তার খুব কাছাকাছি থাকি বা যখন সেটি জিহ্বাকে স্পর্শ করে বা বাহ্যস্থানের এমন কোন আদর্শ জায়গায় থাকে যা আমাদের দেহের কাছাকাছি। আমরা বলতে পারি না, একটি বস্তু থেকে আমরা বিভিন্ন অবস্থায় কি কি সংবেদন পেতে পারি, যতক্ষণ না আমরা বস্তুটি এবং আমাদের দেহ একই বাহ্য স্থানে আছে বলে মনে করি, কেননা প্রধানত বস্তু এবং আমাদের দেহের আপেক্ষিক অবস্থানই ঠিক করে কি ধরনের সংবেদন আমরা বস্তুটির থেকে পাবো।
এখন আমাদের ইন্দ্রিয়-উপাত্তগুলো আমাদের ব্যক্তিগত স্থানে রয়েছে, হয় দেখার স্থান বা স্পর্শ স্থান বা অন্যান্য অস্পষ্ট স্থান যা আমাদের অন্যান্য ইন্দ্রিয়গুলো দিতে পারে। যদি, বিজ্ঞান এবং সাধারণ বোধবুদ্ধি অনুযায়ী, শুধুমাত্র এক সর্বজনগ্রাহ্য বাহ্য স্থান থেকে থাকে, তাহলে অবশ্যই কোন না কোনভাবে ইন্দ্রিয়-উপাত্তের আপেক্ষিক অবস্থানের সঙ্গে আমাদের ব্যাক্তিগত স্থানের মিল থাকবে। ঘটনাটি এরকম মনে করার কোন অসুবিধা নেই : যদি আমরা রাস্তার উপরে একটি বাড়িকে আর-একটি বাড়ি থেকে কাছে দেখি, তাহলে আমাদের অন্যান্য ইন্দ্রিয় এই ঘটনার সাক্ষী থাকবে যে এটি কাছের, উদাহরণস্বরূপ, যদি আমরা রাস্তা ধরে হেঁটে যাই তাহলে এটিতে তাড়াতাড়ি পৌঁছানো যাবে। অন্যান্য ব্যক্তিরাও এই মতে সম্মত হবেন যে বাড়িটি কাছে দেখাচ্ছে তা কাছে রয়েছে। সামরিক মানচিত্রও এই একই মত পোষণ করবে এবং এভাবে সমস্ত কিছুই বাড়িটি এবং তার ইন্দ্রিয়-উপাত্তের সম্পর্কের মধ্যে এক ধরনের স্থানগত সম্পর্ক তৈরি করবে যা আমরা পাবো যখনই আমরা বাড়িটির দিকে দেখবো। এভাবে আমরা মনে করতে পারি যে বাহ্য স্থান সেখানেই আছে যেখানে বাহ্য বস্তুর স্থানগত সম্পর্ক রয়েছে এবং সে সবের সঙ্গে মিল রেখে যেখানে ব্যক্তিগত স্থানে তার অনুরূপ ইন্দ্রিয়-উপাত্ত রয়েছে। এই হল সেই বাহ্যস্থান যা জ্যামিতির আলোচ্যবস্তু এবং পদার্থবিদ্যা ও জ্যোতির্বিদ্যাও যাকে গ্রহণ করে।
মনে করা যাক, বাহ্য স্থান রয়েছে এবং ব্যক্তিগত স্থানের সঙ্গে তার মিল রয়েছে, এর থেকে আমরা কি জানতে পারি? আমরা শুধু সেটাই জানি যা মিল দেখানোর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থাৎ আমরা এর স্বরূপ সম্পর্কে কিছু জানি না। কিন্তু আমরা জানতে পারি বাহ্য বস্তুর সেই ধরনের ব্যবস্থাগুলো যা স্থানগত সম্পর্কের ফল। যেমন, আমরা জানতে পারি কোন গ্রহণের সময় পৃথিবী, চাঁদ ও সূর্য একই সমান্তরাল রেখায় আসে-যদিও আমরা বাহ্য সমান্তরাল রেখার স্বরূপ সম্পর্কে কিছুই জানতে পারি না, যেভাবে আমরা দৃশ্যগত স্থানের সমান্তরাল রেখার সম্পর্কে জানি। এভাবে আমরা দূরত্বগুলোর স্বরূপের থেকে বাহ্য স্থানের দূরত্বের সম্পর্ক সম্পন্ধে অনেক বেশি জানতে পারি। আমরা জানতে পারি একটি দূরত্ব আর-একটির থেকে বেশি, বা এটি অন্যটির মতো এই সমান্তরাল রেখায় রয়েছে; কিন্তু আমাদের বাহ্য দূরত্বের তাৎক্ষণিক জ্ঞান হয় না যা আমাদের ব্যক্তিগত স্থানের দূরত্ব সম্পর্কে হয়, অথবা রঙ, শব্দ বা অন্য ইন্দ্রিয়-উপাত্ত সম্পর্কে হয়। আমরা বাহ্য স্থান সম্পর্কে এই সমস্ত বিষয় জানতে পারি, একজন জন্মান্ধ মানুষ এই দৃশ্য স্থান বিষয়ে যা অন্যদের কাছ থেকে জানে। কিন্তু একজন জন্মান্ধ মানুষ যেরকম দৃশ্য স্থান সম্পর্কে কিছু জানতে পারে না, আমরাও সেরকম বাহ্য স্থান সম্পর্কে কিছু জানি না। আমরা জানতে পারি গুণের সম্পর্কের কথা যা ইন্দ্রিয়-উপাত্তের সঙ্গে মিল রাখার জন্য প্রয়োজন, কিন্তু আমরা জানতে পারি না সেই সবের প্রকৃতি সম্পর্কে যার উপর এই সম্পর্কগুলো দাঁড়িয়ে আছে।
সময়ের ক্ষেত্রে, আমাদের স্থিতিকালের অনুভূতি বা সময় যাওয়ার অনুভূতি ঘড়ির সময় যাওয়ার তুলনায় নিতান্তই অসহযোগী পথপ্রদর্শক। আমাদের অবসন্ন বোধ করা বা কষ্ট পাওয়ার সময়টা যখন আমরা অপেক্ষাকৃত ব্যস্ত থাকি সেই সময়ের তুলনায় অত্যন্ত ধীরে যায় এবং যখন আমরা ঘুমোই তখন মনে হয় সময়ের অস্তিত্বই নেই। এভাবে সময় স্থিতিকাল দ্বারা গঠিত বলে সর্বসাধারণের ও ব্যক্তিগত সময়ের মধ্যে পার্থক্য করা প্রয়োজন, যেরকম স্থানের ক্ষেত্রে করা হয়েছে। কিন্তু যেহেতু সময় পূর্ব এবং পর এই ধারায় তৈরি, তাই এই ধরনের পার্থক্য করার কোন প্রয়োজনীয়তা নেই। সময়ের ধারা যা ঘটনার মধ্যে রয়েছে, যতদূর আমরা দেখতে পাই, তা হচ্ছে একই সময়ের ধারা যা তাদের মধ্যে রয়েছে। কোনভাবেই কোন কারণ দেখনো যাবে না যে এই দুই সময়ক্রম এক নয়। এ একই কথা সাধারণত স্থান সম্পর্কেও সত্য। একটি রাস্তা দিয়ে একদল মানুষ সুশৃঙ্খলভাবে হেঁটে গেলে দলটির আকার বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে আলাদা দেখাবে, কিন্তু সমস্ত দৃষ্টিকোণ থেকে মানুষরা একই ধরনের বিন্যাস দেখবে। এ কারণে আমরা বাহ্য স্থানের ক্ষেত্রেও এই বিন্যাসটিকে সত্য বলে জানবো, অপরপক্ষে এর আকারটি বাহ্য স্থানের সঙ্গে ততক্ষণ মিল রেখে চলবে যতক্ষণ পর্যন্ত এই বিন্যাসের ধারাকে অক্ষুণ্ণ রাখা প্রয়োজন।
এ থেকে যে ঘটনার যে সময়ক্রম রয়েছে বলে মনে হয় তা প্রকৃত সময়ক্রমের সঙ্গে এই, এটি প্রয়োজনীয় একটি সম্ভাব্য ভুল বোঝা থেকে সতর্ক হওয়া। একথা মনে করা উচিত নয় যে বিভিন্ন বাহ্য বস্তুর বিভিন্ন অবস্থার ইন্দ্রিয় উপাত্তগুলোর মত একই সময়ক্রম রয়েছে, যা এসব বস্তুকে দেখতে সাহায্য করে। বজ্র এবং বিদ্যুৎ বাহ্য বস্তু হিসেবে একই সময়ে ঘটে, অর্থাৎ বিদ্যুৎ বাতাসের বাধাদানের সঙ্গে একই সময়ে ঘটে, যেখানে বিপত্তিটা শুরু হয় অর্থাৎ যেখানে বিদ্যুৎ থাকে। কিন্তু যে ইন্দ্রিয়-উপাত্তকে আমরা বজ্রপাতের আওয়াজ বলে মনে করি তা ততক্ষণ পর্যন্ত ঘটেনা যতক্ষণ না বাতাসের বাধাদান আমাদের কাছে এসে পৌঁছায়। একইভাবে সূর্যের আলো আমাদের কাছে পৌঁছাতে আট মিনিট লাগে, অর্থাৎ যখন আমরা সূর্যকে দেখি তখন আমরা আট মিনিট আগের সূর্যকে দেখি। ইন্দ্রিয়-উপাত্ত যে-বাহ্য বস্তুর প্রমাণ দেয় তা হল আট মিনিট পূর্বের বাহ্য সূর্যের প্রমাণ। বাহ্য সূর্য ওই শেষের আট মিনিটে অন্তর্হিত হয়ে গেলেও যে ইন্দ্রিয়-উপাত্তকে আমরা সূর্য দেখা বলছি তার কোন পরিবর্তন হবে না। এটি ইন্দ্রিয়-উপাত্ত এবং বাহ্য বস্তুর মধ্যেকার পার্থক্য দেখানোর প্রয়োজনীয়তাকে নতুন করে সামনে নিয়ে আসে।
স্থান সম্বন্ধে আমরা যা দেখলাম তা ইন্দ্রিয়-উপাত্ত এবং তার বাহ্য প্রতিরূপের সম্বন্ধ সম্পর্কেও প্রযোজ্য। যদি একটি বস্তুকে নীল এবং অপরটিকে লাল দেখায়, তাহলে আমরা যুক্তিসঙ্গতভাবেই অনুমান করতে পারি যে এই দুই বাহ্য বস্তুর মধ্যে কিছু পার্থক্য রয়েছে। আবার দুটি বস্তুকে নীল দেখলে আমরা তাদের মধ্যে মিল রয়েছে বলে মনে করতে পারি। কিন্তু আমরা বাহ্য বস্তুর সেই গুণের সঙ্গে সরাসরি সংযোজিত হওয়ার আশা করতে পারি না যার জন্য এগুলো নীল বা লাল দেখায়। বিজ্ঞান আমাদের জানায়, এই গুণ হল এক ধরনের গতি-তরঙ্গ; এবং এটি জানা বলে মনে হয়, কেননা আমরা যে স্থান দেখি তাতে গতি-তরঙ্গের কথাই চিন্তা করি, কিন্তু এই গতি-তরঙ্গগুলোকে অবশ্যই প্রকৃত স্থানে থাকতে হবে যার সঙ্গে আমাদের কোন প্রত্যক্ষ যোগাযোগ নেই। এভাবে প্রকৃত গতি তরঙ্গগুলোর সেই পরিচিতি নেই যা আমরা তাদের আছে বলে ভেবেছিলাম এবং যা বর্ণ সম্পর্কে প্রযোজ্য তার সঙ্গে অন্যান্য ইন্দ্রিয়-উপাত্তের মিল রয়েছে। এবাবে আমরা দেখি যে যদিও বাহ্য বস্তুর সম্বন্ধের বিভিন্ন জ্ঞাত গুণাবলি রয়েছে যা ইন্দ্রিয়-উপাত্তের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে গ্রহণ করা হয়েছে, তথাপি বাহ্য বস্তুরা তাদের অন্তর্নিহিত স্বভাবের ক্ষেত্রে অজানাই থেকে যাচ্ছে, যতদূর ইন্দ্রিয়ের দ্বারা জানা যায়। এই প্রশ্নটি থেকেই যায় যে বাহ্য বস্তুর অন্তর্নিহিত স্বভাব আবিষ্কার করার অন্য আর কোন উপায় আছে কিনা।
ইন্দ্রয়-উপাত্ত সম্পর্কে সব থেকে স্বাভাবিক প্রকল্প, যদিও শেষ পর্যন্ত সমর্থনযোগ্য নয়, হচ্ছে প্রথমত এটি বাহ্য বস্তু কখনই ইন্দ্রিয়-উপাত্তের মতো হতে পারে না, কিন্তু তারা অনেকটা একই রকম হতে পারে। দৃষ্টান্তস্বরূপ, এই মত অনুযায়ী বাহ্য বস্তুর প্রকৃত রঙ থাকতে পারে এবং সৌভাগ্যবশত আমরা বস্তুর প্রকৃত রঙকে জানতে পারি। কোন একটি বিশেষ মুহূর্তে একটি বস্তুর রঙ সাধারণভাবে একই রকমের হতে পারে, যদিও বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে তা হুবহু এক নয়। এভাবে আমরা মনে করতে পারি যে প্রকৃত রঙ হল এক ধরনের মধ্যবর্তী রঙ, যা বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা বিভিন্ন ছায়ার (Shade) মধ্যবর্তী।
এ ধরনের মতবাদকে হয়তো সুনির্দিষ্টভাবে খন্ডন কর যায় না, কিন্তু এটকে ভিত্তিহীন বলে দেখানো যেতে পারে। এটা পরিষ্কার যে, যে রঙ আমরা দেখছি তা নির্ভর করে আলোর তরঙ্গের উপর যা আমাদের চোখে আঘাত করছে এবং সেই মাধ্যম দ্বারা পরিবর্তিত যা আমাদের এবং বাহ্যবস্তুর মধ্যে বাধাদান করছে; একই সঙ্গে চোখের দিক থেকে আলোর প্রতিফলনের দ্বারাও পরিবর্তিত হচ্ছে, মধ্যবর্তী বায়ু বর্ণকে পরিবর্তিত করছে যদি না তা পুরোপুরি স্বচ্ছ হয় এবং যে কোন তীব্র প্রতিফলন একে পুরোপুরি পরিবর্তিত করতে পারে। সুতরাং যে রঙ আমরা দেখি তা হলো চোখে পৌঁছানোর পর রশ্মির ফল এবং এটি সেই বস্তুর ধর্ম নয় যার থেকে রশ্মিটি আসবে। এভাবে ধরে নেওয়া যেতে পারে চোখে কিছু তরঙ্গ পৌঁছানোর জন্যই আমরা কোন বিশেষ বর্ণ দেখি, যে বস্তুটি থেকে তরঙ্গটি শুরু হয়েছিলো তার কোন বর্ণ থাক বা না-ই থাক। সুতরাং এক্ষেত্রে আসলে ধরে নেওয়া হচ্ছে যে বাহ্য বস্তুর কোন বর্ণ আছে, অতএব এই ধরনের মতের স্বপক্ষে কোন সমর্থনযোগ্যতা নেই। অন্যান্য ইন্দ্রিয়-উপাত্তের ক্ষেত্রেও একই ধরনের যুক্তি প্রয়োগ করা যেতে পারে।
প্রশ্ন ওঠে–এরকম কোন সাধারণ দার্শনিক যুক্তি আছে কিনা যার দ্বারা আমরা বলতে পারি যে যদি জড় সত্য হয় তাহলে তা অবশ্যই এই-এই ধরনের স্বভাব থাকবে। উপরিউক্ত ব্যাখ্যার মাধ্যমে প্রায় সমস্ত দার্শনিকরা, সম্ভবত সকলেই, এই মত পোষণ করেন যে যা কিছু সত্য তা কিছু অর্থে মানসিক অথবা আমরা যা কিছু জানি তা কোন না কোন অর্থে মানসিক। এই ধরনের দার্শনিকদের ভাববাদী বলা হয়। ভাববাদীরা আমাদের বলেন যে জড় বলে যা প্রতিভাত হয় তা আসলে মানসিক : হয় (যেমন লাইবোনিজ বলেন) কোন না। কোন অর্থে স্থূল মন, অথবা (যেমন বার্কলে বলেন) মনের ধারণা, যা আমরা। সাধারণভাবে বলি, যা জড়কে দেখে। এভাবে ভাববাদীরা জড়ের অস্তিত্ব যে মনের থেকে অন্তর্নিহিতভাবে আলাদা তা অস্বীকার করেন। কিন্তু তারা একথা অস্বীকার করেন না যে আমাদের ইন্দ্রিয়-উপাত্ত হল এমন কিছুর প্রতীক, আমাদের ব্যক্তিগত সংবেদনের থেকে যার স্বাধীন অস্তিত্ব রয়েছে। পরবর্তী অধ্যায়ে আমরা সেই কারণগুলো আলোচনা করবো যা আমার মতে ভুল–যেগুলো ভাববাদীরা তাঁদের মতের স্বপক্ষে পেশ করে থাকেন।
৪. ভাববাদ
ভাববাদ শব্দটিকে বিভিন্ন মতাবলম্বী দার্শনিকরা কিছুটা ভিন্ন ভিন্ন অর্থে ব্যবহার করেছেন। আমরা এর দ্বারা সেই মতবাদ বুঝবো যা বলে যা অস্তিত্বশীল বা যা কম-বেশি অস্তিত্বশীল বলে জ্ঞাত হওয়া যায়, তা কোন না কোন অর্থে নিশ্চিত মানসিক। দার্শনিকদের মধ্যে বহুল প্রচারিত এই মতবাদ বিভিন্ন রূপে বর্তমান এবং এটি বিভিন্ন কারণে মানা হয়। এই মতবাদ এত ব্যাপকভাবে প্রচলিত এবং স্বভাবতই এত চিত্তাকর্ষক যে দর্শনের খুব সংক্ষিপ্ত ইতিহাসেও এর কিছু বর্ণনা পাওয়া যায়।
যারা দার্শনিক আলোচনায় অনভ্যস্ত তারা এই ধরনের মতবাদকে অসম্ভব বলে উড়িয়ে দেন। এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে সাধারণ বোধ টেবিল, চেয়ার, সূর্য, চন্দ্র বা বাহ্য বস্তুকে মন এবং মনের বিষয়ের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা বলে মনে করে এবং মন না থাকলেও এদের অস্তিত্ব চলতেই থাকবে একথা মানে। আমরা মনে করি জড়ের অস্তিত্ব মনের বহু পূর্ব থেকেই আছে এবং এটিকে মনের চিন্তার ফল বলে মনে করা খুবই কষ্টকর। কিন্তু সত্য বা মিথ্যা যা-ই হোক না কেন, ভাববাদকেও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
আমরা দেখেছি যে বাহ্য বস্তুর স্বাধীন অস্তিত্ব থাকলেও তারা ইন্দ্রিয়-উপাত্ত থেকে অবশ্যই আলাদা এবং বাহ্যবস্তুর সঙ্গে ইন্দ্রিয়-উপাত্তের মিল রয়েছে ঠিক সেভাবে যেভাবে একটি ক্যাটালগের সঙ্গে তাতে লিপিবদ্ধ বিষয়ের সাদৃশ্য থাকে। এই কারণে সাধারণ বোধ বাহ্য বস্তুর অন্তর্নিহিত স্বভাব সম্বন্ধে আমাদের সম্পূর্ণ অন্ধকারে রাখে এবং যদি এদের মানসিক বলে মনে করার উপযুক্ত কারণ থাকে, তাহলে আমরা কখনই যুক্তিযুক্তভাবে এদেরকে অসম্ভব বলে বাদ দিতে পারি না শুধুমাত্র এই কারণে যে এই মতবাদ অদ্ভুত লাগছে। বাহ্য বস্তু সম্বন্ধে সত্যতা অবশ্যই অদ্ভুত। এতে পৌঁছানো নাও যেতে পারে, কিন্তু যদি কোন দার্শনিক মনে করেন যে তিনি এতে পৌঁছাতে পেরেছেন, তাহলে তিনি যাকে সত্য বলে চিহ্নিত করছেন তা অদ্ভুত হলেও সেটি তাঁর মতের বিরুদ্ধে আপত্তির কোন কারণ হতে পারে না।
সাধারণত জ্ঞানতত্ত্বের ভিত্তিতে ভাববাদ প্রচার করা হয়, অর্থাৎ সেই শর্তগুলো আলোচনার মাধ্যমে যা আমাদের বিষয়গুলো জানার জন্য প্রয়োজন। বিশপ বার্কলে এই ভিত্তিতে ভাববাদ প্রচার করার প্রথম প্রচেষ্টা করেন। তিনিই প্রথম যুক্তির দ্বারা প্রমাণ করেছিলেন–যা বহুলাংশে সঠিক-যে মন নিরপেক্ষভাবে ইন্দ্রিয়-উপাত্তগুলোর অস্তিত্ব থাকতে পারে না। এগুলো অবশ্যই আংশিকভাবে মনের মধ্যে থাকবে এই অর্থে যে, যদি কোন দেখা, শোনা, স্পর্শ করা, গন্ধ নেয়া বা স্বাদ গ্রহণ করা না থাকে তা হলে এদের অস্তিত্ব থাকবে না। তার এই মত বহুলাংশেই সঠিক, যদিও কিছু যুক্তি সঠিক নয়। কিন্তু তিনি যুক্তি দেখিয়েছিলেন যে আমাদের প্রত্যক্ষ একমাত্র ইন্দ্রিয়-উপাত্তের অস্তিত্বকে নিশ্চিত করতে পারে এবং জ্ঞাত হওয়া মানেই মনের মধ্যে থাকা এবং তা মননযোগ্য। এভাবে তিনি সিদ্ধান্তে এসেছিলেন যে মন ছাড়া কোন কিছু জানা যায় না এবং আমার মনে জ্ঞাত না হয়ে যা জানা যায় তা অবশ্যই অন্য কারোর মনে থাকবে।
তার যুক্তি বুঝার জন্য তার ধারণা শব্দের ব্যবহার বুঝা প্রয়োজন। যা কিছু তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায় তাকেই তিনি ধারণা নাম দিয়েছিলেন। দৃষ্টান্তস্বরূপ, ইন্দ্রিয়-উপাত্তগুলোকে জানা যায়। এভাবে আমাদের দেখা একটি বিশেষ রঙ হল একটি ধারণা। একইভাবে যে শব্দ আমরা শুনি বা অন্যান্য বিষয়গুলোও। কিন্তু এই পদটি সম্পূর্ণভাবে ইন্দ্রিয়-উপাত্তের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ নয়। এরকম অনেক বিষয় রয়েছে যাকে মনে করা বা কল্পনা করা যায়। মনে করা বা কল্পনা করার ক্ষেত্রে বিষয়ের সঙ্গে আমাদের তাৎক্ষণিক পরিচিত থাকে। এ সমস্ত তাৎক্ষণিক উপাত্তগুলোকেই তিনি ধারণা বলেছেন।
এরপর তিনি সাধারণ বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তা করেছেন, যেমন একটি গাছ। তিনি দেখিয়েছেন যে যখন আমরা গাছটি দেখি তখন আমরা যা তাৎক্ষণিকভাবে জ্ঞাত হই তা হল কতকগুলো ধারণা। তিনি যুক্তি দিয়ে দেখিয়েছেন যে এরকম মনে করার সামান্যতমও ভিত্তি নেই যে দেখা যাওয়া ছাড়া গাছটির আর কোন সত্যতা আছে, তিনি বলেন এর অস্তিত্ব দেখার উপর নির্ভরশীল, লাতিন ভাষায় এর অস্তিত্বশীলতা হল দেখা। তিনি সম্পূর্ণভাবে স্বীকার করেন যে যখন আমরা চোখ বন্ধ করব বা যখন কোন ব্যক্তি এর কাছে থাকবে না, তখনও গাছটির অস্তিত্ব থাকবে। কিন্তু তিনি বলেন যে এর ধারাবাহিক অস্তিত্বের কারণ হল ঈশ্বরের প্রত্যক্ষ। আসল গাছ যার সঙ্গে বাহ্য বিষয়ের অনুরূপতা রয়েছ, তা ঈশ্বরের মনে ধারণা আকারে রয়েছে। কিন্তু যখন আমরা গাছটি দেখি কথন আমাদের কাছে যা ধারণা আকারে প্রতিভাত হয়, সেগুলো ঈশ্বরের মনে স্থায়ী হিসেবে থাকে যতক্ষণ অবধি গাছটির অস্তিত্বশীলতা রয়েছে। তাঁর মতে আমাদের সমস্ত প্রত্যক্ষ ঈশ্বরের প্রত্যক্ষে আংশিকভাবে অংশগ্রহণ করে, এই অংশগ্রহণের জন্যই বিভিন্ন ব্যক্তি একই গাছ প্রত্যক্ষ করে। এভাবে জগতে মন ও তার ধারণা ছাড়া আর কিছুই নেই এবং এটা সম্ভবও নয় যে কোনকিছু জ্ঞাত হতে পারবে, যেহেতু যা জ্ঞাত হয় তা হল অবশ্যই ধারণা।
এই ধরনের যুক্তিতে নানা দোষ আছে যা দর্শণের ইতিহাসের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ এবং যেগুলোকে সর্বসমক্ষে আনা উচিত। প্রথমত, ধারণা শব্দটি ব্যবহারের মধ্যেই গোলমাল রয়েছে। আমরা সাধারণ ধারণা বলতে কারোর মনের মধ্যে কোন কিছুকে ভাবি এবং যখন আমাদের বলা হয় যে গাছটি ধরণা দিয়ে গঠিত তখন এটি মনে করা খুবই স্বাভাবিক যে যদি তাই হয় তাহলে গাছটি অবশ্যই সম্পূর্ণভাবে মনের মধ্যে রয়েছে, কিন্তু মনের মধ্যে থাকা এই ধারণাটি অত্যন্ত জটিল। আমরা কোন ব্যক্তিকে মনে ধরে রাখার কথা বলি। কিন্তু এর দ্বারা বুঝাই না যে ব্যক্তিটি আমাদের মনে রয়েছে, বরং ব্যক্তিটির চিন্তা আমাদের মনে রয়েছে। যখন কোন ব্যক্তি বলে যে তাকে করতে বলা হয়েছিল এমন কোন বিষয় তার মনের মধ্যে থেকে সম্পূর্ণভাবে চলে গিয়েছে, তখন সে এটা বুঝায় না যে বিষয়টি নিজে কখনও তার মনের মধ্যে ছিল, বরং বিষয়টির চিন্তা পূর্বে তার মনে ছিল কিন্তু পরবর্তীকালে মনের মধ্যে থেকে চলে গিয়েছে। এভাবে, যখন বার্কলে বলেন যদি আমরা গাছটিকে জানতে পারি তাহলে গাছটি অবশ্যই আমাদের মনে থাকবে, তখন আসলে তার যা বলার অধিকার আছে তা হল গাছটির চিন্তা অবশ্যই আমাদের মনে রয়েছে। গাছটি স্বয়ং অবশ্যই আমাদের মনে রেখেছি সে স্বয়ং আমাদের মনের মধ্যে রয়েছে। এই বিভ্রান্তি কোন পারদর্শী দার্শিনিক সত্যিই সৃষ্টি করেছেন বলাটা খুবই মোটা দাগের ব্যাপার, কিন্তু পারিপার্শ্বিক অবস্থা এটিকে সম্ভব করেছে। কিভাবে এটা সম্ভব হয়েছে তা দেখার জন্য আমাদের অবশ্যই ধারণার প্রকৃতি সম্পর্কে প্রশ্নের আরও গভীরে যাওয়া প্রয়োজন।
ধারণার প্রকৃতি সম্পর্কে সাধারণ প্রশ্ন তোলার আগে আমরা অবশ্যই ইন্দ্রিয় উপাত্ত ও বাহ্য বিষয় সম্পর্কিত এই দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রশ্নকে আলাদা করব। বিভিন্ন কারণের জন্য আমরা দেখেছি যে বার্কলে ইন্দ্রিয়-উপাত্তের ব্যাপারে সঠিক ছিলেন যা আমদের গাছের প্রত্যক্ষকে কম বা বেশি ব্যক্তিগত করে তোলে– ব্যক্তিগত এই অর্থে যে এরা গাছের উপর নির্ভর করে এবং গাছটি প্রত্যক্ষ না হলে এরা থাকবে না। কিন্তু এটি তার থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন যুক্তি, যার দ্বারা বার্কলে প্রমাণ করতে চেয়েছেন যা তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায় তা অবশ্যইমনের মধ্যে থাকবে। এই উদ্দেশ্যে আমাদের ইন্দিয়-উপাত্তের উপর নির্ভরতা সম্পর্কে বিস্তারিত যুক্তি দেয়া অপ্রয়োজনীয়। সাধারণত এটি প্রমাণ করা প্রয়োজনীয় যে কোন কিছু জানা মানেই বিষয়গুলো মানসিক হয়ে ওঠে। বার্কলে বিশ্বাস করতেন যে তিনিই এটি প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন। পূর্ববর্তী প্রশ্ন অর্থাৎ ইন্দ্রিয়-উপাত্তও বাহ্য বিষয়ের পার্থক্য নিয়ে নয়, বরং এই প্রশ্নটি নিয়েই এখন আমরা আলোচনা করব।
বার্কলের অর্থে ধারণা কে গ্রহণ করলে, মনের সামনে কোন ধারণা এলেই দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়কে আমাদের বিবেচনা করতে হবে। একদিকে সেই বিষয়টি যার সম্পর্কে আমরা সচেতন–ধরাযাক আমার টেবিলের রঙ এবং অন্যদিকে প্রকৃত সচেতনতা, বিষয়টিকে উপলব্ধি করার মানসিক ক্রিয়া। মানসিক ক্রিয়া নিঃসন্দেহেই মানকি, কিন্তু মনে করার এরকম কোন কারণ আছে কি যে, যে বিষয়টি জানা হচ্ছে তা কোন অর্থে মানসিক? রঙ সম্পর্কীয় আমাদের পূর্ববর্তী যুক্তিগুলো এটিকে মানসিক বলে প্রমাণ করে না। এগুলো শুধুমাত্র এটাই প্রমাণ করে যে এদের অস্তিত্ব আমাদের ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে বাহ্য বস্তুর সম্বন্ধের উপর নির্ভর করে এই নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে টেবিলের উপর। অর্থাৎ এর প্রমাণ করে যে, কোন বিশেষ বিন্দুতে একটি চোখ স্থাপিত হলে, একটি নির্দিষ্ট আলোয় একটি নির্দিষ্ট বর্ণ বিদ্যমান থাকবে। এই যুক্তিগুলো প্রমাণ করে না যে রঙটি দর্শনকারীর মনের মধ্যে রয়েছে।
বার্কলের মত অর্থাৎ রঙটি অবশ্যই মনের মধ্যে থাকবে– এই মতটির সম্ভাব্যতা নির্ভর করছে বিষয়টিকে উপলব্ধির ক্রিয়ার সঙ্গে উপলব্ধি করার বস্তুটিকে গুলিয়ে ফেলার ওপর। এদের মধ্যে যে কোনটিকেই ধারণা বলা যেতে পারে, হয়তো বার্কলে এদের যে কোনটিকেই ধারণা বলতেন। কাজটি নিঃসন্দেহে মনের মধ্যে রয়েছে : এই কারণে যখন আমরা কাজটি সম্পর্কে চিন্তা করি, তখন আমরা সহজেই ধরে নিই যে ধারণাগুলি অবশ্যই মনের মধ্যে রয়েছে। এ-কথাটা শুধুমাত্র তখনই সত্য যখন ধারনাগুলোকে জানার কাজ হিসেবে নেয়া হয়, তা ভুলে গিয়ে আমরা ধারণাগুলো মনের মধ্যে আছে এই বচনটিকে ধারনার অন্য অর্থে স্থানান্তরিত করি অর্থাৎ বিষয়গুলোকে জানার থেকে আমাদের জানার কাজে। এভাবে মনের অজান্তেই বাকচাতুরীর মাধ্যমে আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হই যে যা আমরা জানতে পারি তা অবশ্যই আমাদের মনের মধ্যে থাকে। বার্কলের যুক্তির এটি মনে হয় সঠিক বিশ্লেষণ এবং আসল দোষ যার উপর এটি দাঁড়িয়ে আছে।
বিষয়কে জানার ক্ষেত্রে কাজ ও বিষয়ের মধ্যে পার্থক্যের এই প্রশ্নটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ, যেহেতু আমাদের জ্ঞান অর্জনের সম্পূর্ণ ক্ষমতাই এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে। নিজের বাইরের বিষয়বস্তুর সাথে পরিচিত হওয়ার ক্ষমতাই মনের প্রধান বৈশিষ্ট্য। বিষয়বস্তুর সঙ্গে পরিচিত হওয়াটা মন ও তার থেকে আলাদা কোন কিছুর সম্বন্ধের উপরনির্ভর করে। এটিই বিভিন্ন বিষয়বস্তুকে জানার ব্যাপারে মনের শক্তি তৈরি করে। যদি আমরা বলি যে জানা বিষয়বস্তুগুলো অবশ্যই মনের মধ্যে থাকে, তাহলে হয় আমরা অন্যান্যভাবে মনের জানার শক্তিকে সীমাবদ্ধ করি, নয়তো নিছক পুনরুক্তি করি। যদি আমরা মনে করি মনের মধ্যে আর মনের সামনে একই বিষয়, তাহলে আমরা পুনরুক্তি করি, অর্থাৎ যদি আমরা শুধুমাত্র মনের দ্বার জানাকে বুঝাই। কিন্তু যদি আমরা এটা মনে করি তাহলে আমাদের স্বীকার করতে হবে যে, এই অর্থে যা মনের মধ্যে রয়েছে তা মানসিক না-ও হতে পারে। এবাবে যখন আমরা জ্ঞানের প্রকৃতি অনুধাবন করি, তখন বার্কলের যুক্তি রূপ ও অন্তর্বস্তু উভয়ই ভুল বলে পরিগণিত হয় এবং ধারণাগুলো অর্থাৎ বিষয়কে অনুধাবন করা অবশ্যই মানসিকতার তাঁর এই ভাবনার ভিত্তিগুলোর কোন কার্যকারিতা থাকে না। সুতরাং ভাববাদের সপক্ষে তার যুক্তি বাতিল করা যেতে পারে। অন্য আর কোন ভিত্তি আছে কিনা তা এখন দেখা প্রয়োজন।
প্রায়শই বলা হয় এবং যেন এটি একটি স্বতঃসিদ্ধ সত্য এমনভাবেই বলা হয় যে যা আমরা জানি না তার অস্তিত্ব সম্পর্কে আমরা কিছু জানতেও পারি না। বলা হয় যা কিছু আমাদের অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক তা অবশ্যই আমাদের দ্বারা জ্ঞাত হবে। এর থেকে এই ধারণা আসে যে বস্তু যদি এমন কিছু হয় যার সম্পর্কে আমরা জানতে পারি না, তাহলে বস্তু হল এমন কিছু যার অস্তিত্ব সম্পর্কে আমরা জ্ঞাত হতে পারি না এবং আমাদের কাছে এই বিষয়ের কোন গুরুত্বও থাকে না। কিছু দুর্বোধ্য কারণে সাধারণভাবে ধরেই নেয়া হয় যে যা আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয় তা সত্য হতে পারে না; অতএব বস্তু, যদি এটি মন বা মানসিক ধারণার দ্বারা গঠিত না হয়, তাহলে তা নিতান্তই অসম্ভব ও নিছক কল্পনা মাত্র।
আমাদের বর্তমান অবস্থায় এ ধরনের যুক্তি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা অসম্ভব, কেননা এটি এমন কতকগুলো দিকের প্রশ্ন তোলে যার প্রাথমিক আলোচনা প্রয়োজন। তবে এই যুক্তিকে নাকচ করার কতকগুলো কারণ এ মুহূর্তেই বিবেচনা করা যেতে পারে। শেষ থেকে শুরু করা যাক; যার ব্যবহারিক কোন গুরুত্ব আমাদের কাছে নেই তা কেন সত্য হতে পারবে না, তার কোন কারণ নেই। এটি সত্যি যে তত্ত্বগত প্রয়োজনীয়তাকে হিসেবের মধ্যে নিলে গ্রহণ করা হয় যা-কিছু সত্য তার কিছু গুরুত্ব আমাদের কাছে থাকবেই, যেহেতুে জগতের সত্যতা সম্পর্কে জ্ঞানলাভে ইচ্ছুক ব্যক্তি হিসেবে বিশ্বপ্রহ্মান্ডের যে কোন বিষয় সম্পর্কেই আমাদের কিছু আগ্রহ থাকে। কিন্তু এই ধরনের আগ্রহকে বিচারের অন্তর্ভূক্ত করা হলে, ব্যাপারটা এমন হবে না যে বস্তুর কোন গুরুত্বই আমাদের কাছে নেই, শর্তসাপেক্ষে যে এটির অস্তিত্ব রয়েছে, এমনকি যদি আমরা এর অস্তিত্বের কথা জানতে সক্ষম না হই তাহলেও। আমরা স্বাভাবিকভাবেই সন্দেহ প্রকাশ করতে পারি যে হয়তো এটির অস্তিত্ব রয়েছে এবং এটি সত্যিই আছে কিনা তা ভেবে অবাক হই। এভাবে এটি আমাদের জ্ঞানলাভের ইচ্ছার সঙ্গে সংযুক্ত এবং হয় এই ইচ্ছা চারিতার্থ করার অথবা তা বিফল করার মতো গুরুত্ব এর আছে।
অন্যদিকে, এটি কোনভাবেই সত্য নয়, বরং বলতে গেলে মিথ্যাই, যে যা আমরা জানি না তার অস্তিত্ব নেই। জানা এই শব্দটি এখানে দুটি ভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে : ১. প্রথম অর্থে এটি সেই ধরনের জ্ঞানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য যা ভ্রান্তির বিপরীত, যে-অর্থে আমরা যা জানি তা সত্য, যে অর্থটি আমাদের বিশ্বাস ও প্রত্যয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, অর্থাৎ যাকে বিধান (Judgement) বলা হয়। শব্দটির এই অর্থে আমরা জানি যে কোন কিছু ঘটেছে। এই ধরনের জ্ঞানকে সত্যের জ্ঞান হিসাবে বর্ণনা করা যেতে পারে। ২. উপরোক্ত জানা শব্দটির দ্বিতীয় অর্থে, শব্দটি আমাদের বিষয়বস্তুর জ্ঞানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়, যাকে আমরা পরিচিতি বলতে পারি। এই অর্থেই আমরা ইন্দ্রিয়-উপাত্তকে জানি।
এভাবে যে বিবৃতিটিকে সত্য বলে মনে হচ্ছিল তা পুনর্বর্ণিত হলে এ রকম দাঁড়ায়-আমরা কখনই সঠিকভাবে বিচার করতে পারি না যে যা কিছুর সঙ্গে আমরা পরিচিত নই তা অস্তিত্বশীল নয়। এই বক্তব্য কোনভাবেই সত্য নয়, বরং স্পষ্টতই মিথ্যা। চীনের সম্রাটের সঙ্গে পরিচিত হবার সৌভাগ্য আমার হয়নি, কিন্তু আমি সঠিকভাবেই জানি যে তিনি আছেন। অবশ্য বলা যেতে পারে যে আমি এটা জানি কেননা অন্যান্য ব্যক্তি তাকে জানে। তবে এটি একটি অপ্রাসঙ্গিক উক্তি হবে, কারণ, নীতিটি সত্য হলে, আমি জানতেই পারি না যে অন্য কারোর তাঁর সঙ্গে পরিচিতি আছে। তাছাড়া এর সপক্ষেও কোন কারণ নেই যে যার সঙ্গে কোন ব্যক্তির পরিচিতি নেই তার অস্তিত্ব সম্পর্কে কেন আমি জানতে পারব না। এই বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ এবং এটি বিস্তৃত ব্যাখ্যার অবকাশ রাখে।
যদি আমি কোন অস্তিত্বশীল বিষয়ের সঙ্গে পরিচিত থাকি, তাহলে আমার সেই পরিচিতিই বিষয়টির অস্তিত্ব সম্পর্কে আমাকে নিশ্চিত করে। কিন্তু বিপরীতে এটা সত্য নয় যে যখনই আমি জানতে পারি কোন একটি বিষয়ের অস্তিত্ব আছে, তখন আমাকে বা অন্য কাউকে বিষয়টি সম্পর্কে অবশ্যই পরিচিত থাকতে হবে। যেসব ক্ষেত্রে পরিচিতি ছাড়াই আমি যথার্থ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি, সেসব ক্ষেত্রে যা ঘটে তা হল-বিষয়টি আমি বর্ণনার মাধ্যমে জানি এবং কোন সাধারণ নীতির ভিত্তিতে এই বর্ণনার সঙ্গে মেলে এমন বিষয়ের অনুমান যে বিষয়ের অস্তিত্ব আমি জেনেছি তার থেকে করা হয়। এই বিষয়টি পুরোপুরি বুঝতে হলে সর্বপ্রথমে পরিচিতির দ্বারা জ্ঞান ও বর্ণনার দ্বারা আমাদের পার্থক্য করা প্রয়োজন, তারপর বিচার করা দরকার সাধারণ নীতির (যদি কিছু থাকে) কোন্ ধরনের জ্ঞানের মধ্যে সেই নিশ্চয়তা থাকে, যেরকম নিশ্চয়তা থাকে আমাদের নিজেদের অভিজ্ঞতার অস্তিত্ব সংক্রান্ত জ্ঞানের। পরবর্তী অধ্যায়গুলোতে এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করা হবে।