মিসির আলি সিরিজ Pdf ডাউনলোড || Misir Ali somogro 1,2,3 by humayun ahmed Pdf Download
Misir Ali series all book pdf download
লেখক- হবুমায়ূন আহমেদ
হুমায়ূন আহমেদ মিসির আলি pdf সিরিজ Pdf ডাউনলোড
মিসির আলি সিরিজের সব বইয়ের নাম:
২. নিশীথিনী ১৯৮৮
৩ .নিষাদ ১৯৮৯
৪ .অন্যভুবন ১৯৮৭
৫ .বৃহন্নলা আগস্ট ১৯৮৯
৬ .ভয় (“চোখ”, “জিন-কফিল” ও “সঙ্গিনী” নামক তিনটি গল্পের সংকলন) মে ১৯৯১
৭ .বিপদ ১৯৯১
৮ .অনীশ মে ১৯৯২ প্রকাশনী
৯. মিসির আলি অমনিবাস-১ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৩
১০ .মিসির আলির আমীমাংসিত রহস্য ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬
১১. আমি এবং আমরা ১৯৯৩
১২. হিমুর দ্বিতীয় প্রহর (হিমু চরিত্রের সাথে মিসির আলির সাক্ষাৎ) ১৯৯৭
১৩ .তন্দ্রাবিলাস ২০০৯
১৪.আমিই মিসির আলি ফেব্রুয়ারি ২০০০
১৫. বাঘবন্দী মিসির আলি
১৬ .কহেন কবি কালিদাস২০০৫
১৭ .মিসির আলী অমনিবাস-২ ফেব্রুয়ারি ২০০৬
১৮ .হরতন ইশকাপন ২০০৮
১৯.মিসির আলির চশমা ফেব্রুয়ারি ২০০৮
২০ মিসির আলি!আপনি কোথায়? ফেব্রুয়ারি ২০০৯
২১ .মিসির আলি UNSOLVED জুলাই ২০০৯
২২ .হিমু মিসির আলি যুগলবন্দি ২০১০
২৩ .পুফি ২০১১
২৪. যখন নামিবে আঁধার ২০১২
২৫ .মিসির আলী অমনিবাস-৩ ২০১৩
ডাউনলোড লিংকঃ click here
রাহিল খান ভাইয়ের গল্পটি প্রমোট করা হল- খুব সুন্দ্রর গল্প।
#পূর্ণচক্র (কিঞ্চিৎ ১৮+)
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছে মিসির আলি(আসিফ) । লাল রঙের জমিন, বুকের কাছটায় সাদা এম্ব্রয়ডারি করা পাঞ্জাবী পড়েছে সে। তাকে মানিয়েছে বেশ। ফর্সা ছেলেকে যেকোন রঙেই মানায়। লাল হলে তো কথায়ই নেই। নিজের রূপের কথা ভেবে আহ্লাদিত হয় আসিফ। ‘ছেলেদের রূপ নয়, গুণই আসল’ কথাটা সে বিশ্বাস করে না। কারণ তার কোন গুণ না থাকা সত্ত্বেও শিল্পপতি বাবার অঢেল সম্পত্তি আর বাহ্যিক সৌন্দর্য্য দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ সব ক্ষেত্র পার করে আসতে পেরেছে সে।
.
মিসির আলি(আসিফ) যখন আয়নায় নিজেকে দেখতে ব্যস্ত তখনই রিনরিনে কণ্ঠে মহুয়া বলল, ‘একটু সরো না প্লিজ। আমাকেও একটু দেখতে দাও।’ পেছন ফিরে ওকে দেখে অবাক হয়ে গেল মিসির আলি । এতো সুন্দর লাগছে মহুয়াকে! মহুয়া এমনিতেই অনেক বেশি সুন্দরী। ফর্সা চেহারা, লম্বাটে চোখ, বাঁশির মতো নাক, চিকন চিবুক, সবমিলিয়ে নজরকাড়ার মতো চেহারা ওর। হাসলে মনে হয় মুক্তো ঝরে পড়ছে। শরীরের গাঁথুনী একেবারে নায়িকার মতো। লাল পাড়ের সাদা শাড়ি, গলায় কানে লাল মুক্তোর মালা আর দুল, হাত ভর্তি লাল সাদা কাঁচের চুড়ি, লম্বা বেনীতে বেলি ফুলের মালা।সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে ফুল বাগানে ঘুরতে আসা কোন পরী, ভুল করে ওর ঘরে ঢুকে পড়েছে।
.
-কী দেখছো হাঁ করে!
রিনরিনে কণ্ঠটা আবারও শুনে ধ্যান ভাঙলো মিসির আলির। হেসে বলল,
-তুমি সামনে থাকলে আর কোনদিকে কি চোখ যায়? বিশ্বাস করো তোমাকে নিয়ে বাইরে যেতে একদমই ইচ্ছে করছে না। আমার বউকে কেউ লোলুপ দৃষ্টিতে দেখবে এটা আমি সইতে পারবো না।
মহুয়া ভ্রু কুঁচকে ফেলে।
-এসব আবার কী কথা! লোলুপ দৃষ্টিতে কেন দেখবে।
মিসির আলি ওর কোমড় জড়িয়ে ধরে কাছে টেনে
বলল,
-তোমাকে দেখতেই এত সুন্দর লাগছে! যে দেখবে সে চোখ সরাতে পারবে না। তুমি আমার বউ না হয়ে অন্য কারো বউ হলে তো আমি দেখা মাত্রই তুলে নিয়ে যেতাম।
.
কথাটা শুনে মহুয়ার কান লাল হয়ে গেল। ধাক্কা দিয়ে মিসির আলিকে সরিয়ে দিয়ে বলল,
-তুমি না মাঝে মাঝে ভীষণ বাজে বকো। এখন চলো, দেরি হয়ে যাচ্ছে তো।
সে আর মহুয়া বেরিয়ে পড়ল। গন্তব্য টিএসসি চত্বর। পহেলা বৈশাখ উদযাপন উপলক্ষ্যে বর্ণাঢ্য উৎসব হচ্ছে সেখানে।
.
মিসির আলি , যার ডাকনাম আসিফ। তার বাবা আমজাদুর রহমান। আমজাদুর রহমান বহু কষ্টে নিজের পায়ে নিজে দাঁড়িয়েছেন। আজ তিনি দেশের অন্যতম শিল্পপতিদের একজন। নিজের প্রথম বয়সটা দুঃখ, কষ্ট আর ভোগান্তিতে কেটেছে তার। তাই ছেলেকে এ সব কিছুর স্পর্শের বাইরে রেখেছিলেন। মিসির আলি বড় হয়েছে আরাম, আয়েশ আর ভোগ বিলাশে। যখন যেটা চেয়েছে সেটাই পেয়েছে। মহুয়াও এরকমই আসিফের ‘চাহিবামাত্র পাওয়া’ গুলোর একটি। তাইতো সে মিসির আলিকে তার ডাকনাম আসিফ বলেই আদর করে ডাকে।
মহুয়াকে প্রথম যেদিন দেখে সেদিনই ওর পিছু নেই সে। ঠিক অন্য মেয়েদের যেভাবে বিরক্ত করতো, ওর সাথেও তাই করবে ভেবেছিল। অন্য মেয়েরা যেমন ভিতু হয় অথবা দু’চারটা কথা শুনিয়ে দেয়, নাহয় চুপচাপ সহ্য করে যায়, মহুয়া এসবের কিছুই করেনি। মুখোমুখি হয়ে তাকে বলেছিল, “আমাকে পছন্দ হয়েছে? তাহলে আমার পেছন পেছন ঘুরে কী হবে বলুন তো? সময় নষ্ট। তারচেয়ে বরং এক কাজ করুন। আমার বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠান। বিয়ে করুন আমাকে। বিয়ের পর ভালো না লাগলে তালাক দিয়ে দেবেন। আমি কোন ক্ষতিপূরণ দাবি করব না। এভাবে পেছন পেছন ঘুরে নিজের সময়ও কেন নষ্ট করবেন? আমাকেও কেন বিরক্ত করবেন?”
সোজাসাপ্টা কিন্তু কাটা কাটা কথাগুলো শুনে আসিফ হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। তারপর ঘোর কাটতেই দেখে মহুয়া নেই। বাসায় ফিরে তার বলা কথাগুলো মনে পড়ছিল বারবার। ভালো করে ভেবে দেখল মহুয়ার প্রস্তাবটা মন্দ নয়। আর কতো মেয়েদের পিছে ঘুরবে ও! তারচেয়ে একেবারের জন্য পেয়ে যাওয়া অনেক ভালো হবে। আর সে তো বলেই দিয়েছে ভালো না লাগলে তালাক দিতে পারবে। তখন পরে আরেকটা বিয়ে করতে পারবে। অর্থাৎ আরেকটা সুন্দরী মেয়ে! আর আজকাল বিয়ে-তালাক-পুনরায় বিয়ে এসব একেবারে সাধারণ ব্যাপার হয়ে গেছে।
আসিফ দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়। তারপর বাবাকে গিয়ে বলে, ‘আমি এই মেয়েকে বিয়ে করতে চাই।’ আসিফের বাবা অবাক হন। আবার খুশিও হন। যাক উড়নচণ্ডী ছেলেটা তাহলে সংসারী হবার মনঃস্থির করেছে! এ তো খুশির কথা!
খোঁজ খবর নিয়ে জানা গেল, মহুয়ার বাবা একজন ছাপোষা সরকারী কর্মচারী। অল্প বেতন দিয়ে পুরো মাস কোনভাবে চলে যায়। একটাই মেয়ে। সেই মেয়ের মা, অধিক অর্থ উপার্জনে অক্ষম স্বামীকে ফেলে অন্য পুরুষের হাত ধরে অজানায় পাড়ি জমিয়েছিল। এরপর আর বিয়ে করেননি মহুয়ার বাবা। আমজাদুর রহমান প্রথমে রাজি না হলেও ছেলের পছন্দের কাছে হার মানেন। তাছাড়া গরীব ঘরের মেয়েরা শান্ত শিষ্ট, সতী লক্ষী টাইপের হয়। তাই তিনি মহুয়াকে ছেলের বউ করে আনার সিদ্ধান্ত নিলেন।
অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই মহুয়া আসিফের স্ত্রী হয়ে ঘরে আসে। অবশ্য বিয়ের আগেই আমজাদুর রহমান বিরাট অংকের টাকা ধরিয়ে দিয়ে মহুয়ার বাবাকে বলেছিলেন, “যতো জলদি পারো এ শহর ছেড়ে চলে যাও। তোমার মতো একটা রাস্তার লোককে বেয়াই হিসেবে পরিচয় দেয়ার ইচ্ছে নেই আমার।” মহুয়ার বাবাও মেয়ের সুখের কথা ভেবে দ্বিমত করেননি।
.
আসিফ(আসিফ) মহুয়াকে নিয়ে অনেক সুখে আছে। কিন্তু এটাও কি অন্য সবকিছুর মতো আসিফের ক্ষণিকের মোহ! সে একবারও ব্যাপারটা ভেবে দেখেনি। বিয়ের এখন মোটে একমাস হচ্ছে। সে তো খুশিই আছে, মহুয়ার মনের কথা কিন্তু সে একবারও জানতে চায়নি। সে আসিফের স্ত্রী হয়ে সুখি কিনা, বাবাকে দেখতে ইচ্ছে করে কিনা, এ সব কিছু আসিফের কাছে মুখ্য নয়। সে যা চেয়েছে তাই পেয়েছে, চোখ ধাঁধানো রূপসী ওর স্ত্রী এটাই ওর গর্বের বিষয়। তবে দিনে দিনে মহুয়ার জন্য মনের গভীরে একটু একটু মায়া জমছে। এটাকে কি ভালোবাসা বলে? আসিফ জানে না। জানতে চায়ও না। এখন ভালোই তো আছে। যেমন যাচ্ছে দিন, মন্দ তো নয়। যাক না এভাবেই। পরেরটা পরে দেখা যাবে।
.
প্রচণ্ড ভিড়ের মাঝে ওদের রিক্সাটা একটু একটু করে এগোচ্ছে। চলেই এসেছে প্রায়, আরেকটু সামনে গিয়ে রিক্সা থেকে নেমে পড়বে। আসিফ মহুয়াকে নিয়ে মোবাইলে সেলফি তুলছে। দু’তিনটা ছবি ফেসবুকে আপলোডও করে ফেলেছে। সবাইকে দেখাতে হবে তো ওরা কতো সুন্দর ‘কাপল’। স্ট্যাটাস, চেক ইন এসবে ব্যস্ত তখনই মহুয়ার আর্তনাদ শুনলো সে। মোবাইল থেকে চোখ তুলে ওর দিকে তাকালো। হাতের পার্সটা বুকের সাথে শক্ত করে চেপে ধরেছে, চোখ দুটো পানিতে টলমল করছে। ব্যাপারটা কী বোঝার জন্য মাথা ঘুরিয়ে এদিক ওদিক তাকালো আসিফ। দুটো ছেলে মহুয়ার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। দাঁত বের করে হাসছে। আসিফ দেখল, ছেলেদুটো বারবার তার বুকে হাত দেয়ার চেষ্টা করছে। একারণেই সে পার্সটাকে বুকের সাথে চেপে ধরে রেখেছে। এসব দেখে আসিফের মাথায় রক্ত উঠে গেল। একজনের হাত ধরে ফেলে চেঁচিয়ে উঠল সে, ‘কী? কী হচ্ছে এসব!’
.
তখনই কোত্থেকে আরও চার পাঁচজন এসে রিক্সাটাকে ঘিরে ধরল। দু’একজন মহুয়ার শরীরে হাত দেয়ার চেষ্টা করছে। বাকিরা আসিফের হাত পা চেপে ধরেছে। ফলে আসিফ একটুও নড়তে পারছে না। মহুয়া ভয়ে রিক্সার আরও ভেতরে সিঁটিয়ে গেল। কিন্তু কোন লাভ হলো না। ছেলেগুলোর হাত থেমে নেই। রিক্সাচালক রিক্সা থামিয়ে নিষ্ক্রিয় ভাবে একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। যেন চায়ের দোকানের সামনে সে, ভেতরে চৌদ্ধ ইঞ্চি টিভিতে রমরমা বাংলা সিনেমা চলছে। প্রতিটি দৃশ্য সে নীরবে উপভোগ করছে।
কোন বাঁধা না পাওয়াতে ছেলেগুলো মহুয়াকে রিক্সা থেকে নামিয়ে ফেলতে সক্ষম হলো। ওর চিৎকার, কান্না আর বাঁচার আকুতি আশেপাশের পথচারীদের কানেই যাচ্ছে না যেন। আসিফ হাত পা ছোঁড়ার অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো। শুধু বৃথা আষ্ফালন করে বলতে লাগল,
-কুত্তার বাচ্চারা আমাকে ছাড়।
ওদের মধ্যেই একজন বলল,
-ছাড়ব তো। আগে তোমার মালটাকে খাইয়া শ্যাষ করি তারপর।
আসিফের কানে কথাটা চপেটাঘাতের মতো লাগলো। কী বলছে এরা! আরেকবার সর্বোচ্চ শক্তিতে ও নড়তে চাইল। কিন্তু তারচেয়ে দ্বিগুন শক্তিতে ছেলেগুলো ওকে রিক্সা থেকে মাটিতে ফেলে দিল।
.
উপুর্যূপরী আসিফের মুখে ও মাথায় লাথি মারছে ছেলেগুলো। ওর রক্তে রঙ বেরঙের নকশা করা পিচঢালা রাস্তা লাল হয়ে যাচ্ছে। মাথায় ভোঁতা যন্ত্রণা হচ্ছে আসিফের। তারপরও মহুয়ার জন্য দুশ্চিন্তা হচ্ছে। খুব কষ্টে একটু করে মাথাটা তুলে দেখার চেষ্টা করলো। কয়েকটা ছেলে এরইমধ্যে মহুয়ার শাড়ি খুলে ফেলেছে। ছেঁড়া ব্লাউজ উন্মুক্ত করে দিয়েছে তার অন্তর্বাস।
চোখে ঝাপসা দেখছে আসিফ। ওটা কি মহুয়া? না তো! অন্য একটা মেয়ে। মেয়েটাকে কোথায় যেন দেখেছিল আগে। একী! ছেলেগুলোর মধ্যে একজনকে হুবহু আসিফের নিজের মতোই মনে হচ্ছে। যে চেহারা নিয়ে গর্ব করে সেই চেহারাটাই ওর দিকে তাকিয়ে যেন বিদ্রুপের হাসি হাসছে।
.
হঠাৎ আসিফ খুব জোরে শক্ত কিছুর আঘাত পেল মাথায়। বুঝতে পারলো কপাল ফেঁটে গরম রক্ত গড়িয়ে পড়ছে চোখের ওপর। চোখ বন্ধ হয়ে আসতে চাইছে। কিন্তু ও একদৃষ্টিতে প্রায় বিবস্ত্র মহুয়ার দিকে চেয়ে আছে। মহুয়ার মতো কিন্তু যেন মহুয়া না। ধর্ষণকারী সবার চেহারা কেমন যেন বদলে গেছে। সবাই যেন আসিফের খুব পরিচিত। একসাথে অনেক কিছু মনে পড়ছে তার, ঠিক ফ্লাশব্যাকের মতো। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে মন বলছে, ‘আমি কি বেঁচে থাকবো? বেঁচে থাকলেও আমার চোখ কি ঠিক থাকবে? আমি কি আয়নাতে নিজের চেহারা আবার দেখতে পাবো? মহুয়ার মিষ্টি চেহারাটা কি আর কখনো দেখার সৌভাগ্য হবে আমার?
.
হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে আসিফ। চোখে ব্যান্ডেজ। পহেলা বৈশাখের দূর্ঘটনাটার আজ তৃতীয় দিন। ইন্সপেক্টর রাশেদ খান আসিফের সামনে বসে আছে। কর্তব্যরত ডাক্তার রুটিন চেকআপ করে বেরিয়ে গেলে রাশেদ খান কথা তুলল,
-কেমন আছেন আসিফ?
আসিফ নিস্পৃহ কণ্ঠে বলল,
-কেমন আছি জানতে চাওয়াটা হাস্যকর ইন্সপেক্টর। প্লিজ কাজের কথা বলে চলে যান।
রাশেদ খান বলল,
-আই এম সরি। আপনার মানসিক অবস্থা বুঝতে পারছি। কিন্তু আপনার বাবা বলছেন আপনি নাকি মামলা করতে চাচ্ছেন না। স্ট্রেঞ্জ! আমি আপনার মুখ থেকেই শুনতে এসেছি, কথাটা কি ঠিক?
.
আসিফ জবাব দিল,
-হ্যাঁ ঠিকই বলেছে বাবা। আমি মামলা করতে চাই না। তাছাড়া আমি ওদের কাউকেই চিনি না। কার নামে মামলা করব!
-আপনার চিনতে হবে না। আমাদের কাছে সিসিটিভি ফুটেজ আছে। আমরা কয়েকজনকে শণাক্ত করেছি। সবাই গা ঢাকা দিয়েছে। তারপরও আমরা খুঁজে বের করে ফেলব। আপনি শুধু মামলা করে স্বীকারোক্তি দিন।
আসিফ বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর শান্ত কণ্ঠে বলল,
-ওদের কাউকে পেলে গ্রেফতার করবেন না। ছেড়ে দেবেন। আমার কোন অভিযোগ নেই।
.
রাশেদ খান খুব অবাক হলো কথাগুলো শুনে। সাথেই সাথেই জিজ্ঞেস করলো,
-ছেড়ে দেব! অভিযোগ নেই কেন আপনার! আপনার স্ত্রীকে তো ওরা…
-শুনুন, আমি অজ্ঞান হওয়ার পর ওরাই আমাকে হাসপাতালে নিয়ে আসে। আমার বাবাকে ফোন করে। তারপর বাবার কাছে একটা চিঠি রেখে যায়।
-চিঠি!
ইন্সপেক্টর রাশেদ বুঝতে পারে এটা স্বাভাবিক কোন ঘটনা না। এর মধ্যে লুকিয়ে আছে গূঢ় কোন রহস্য। তাই আসিফের উদ্দেশ্যে বলে,
-আপনি আমাকে সব খুলে বলুন। না হলে
আমি এই কেসের কোন গতি করতে পারছি না। পাবলিক আমাদের দিকে চেয়ে আছে। এরকম একটা ঘটনার বিচার তারা অতি দ্রুত দেখতে চায়।
আসিফ বুঝতে পারছে না কোথা থেকে শুরু করবে। ঘটনার শুরুটা হয়েছিল তিন বছর আগে।
.
সেদিনও নববর্ষ ছিল। আসিফ ও তার কয়েকটা বন্ধু টিএসসিতে ‘ফান’ করছিল। এই ফানটা হলো ভীড়ের মাঝে মেয়েদের গায়ে হাত দেয়া। সুযোগ বুঝে স্পর্শকাতর গোপন অঙ্গগুলো ছুঁয়ে দেয়া। প্রথমে কিছুক্ষণ এটা করেই মজা পাচ্ছিলো তারা। কিন্তু পরে নেশার মতো হয়ে যায়। একটা সময় মনে হয় এভাবে আর হবে না। বেশি কিছু করতে হবে। তখন তারা চারপাশে উপযুক্ত শিকার খুঁজছিল। পেয়েও গেল অল্প সময়ের মধ্যে।
.
রিক্সা করে একটা দম্পতি টিএসসিতে ঢুকছিল। দেখেই মনে হচ্ছিল নতুন বিবাহিত তারা। মেয়েটার মুখে লাজুক আভা, ছেলেটার চোখে মুখে মুগ্ধতা। ওরা এই মেয়েটাকেই টার্গেট করে। প্রথমে দুজন রিক্সার পাশে গিয়ে মেয়েটাকে স্পর্শ করতে চায়। ছেলেটা বাঁধা দিতে চাইলে বাকিরা এসে ওকে ধরে রাখে। তারপর মাটিতে ফেলে মারতে থাকে। ওদিকে মেয়েটাকে নিয়ে আসিফ ও কয়েকজন মেতে উঠেছে বুনো উল্লাসে। এত ভীড়ের মধ্যে পথচারীরা চাইলেও কিছু করতে পারছিল না। তারমধ্যে কয়েকজন আবার সুযোগ বুঝে ওদের সাথে যোগ দিয়েছে। চিৎকার-চেঁচামেচি, ধাক্কাধাক্কি এসবের মধ্যে মেয়েটার আর্তচিৎকার চাপা পড়ে গিয়েছিল। ছেলেটাও মারের চোটে একসময় জ্ঞান হারায়। আসিফরা ঐ ভীড়ের মাঝেই মেয়েটার সর্বস্ব কেড়ে নিতে পেরেছিল। কোন অসুবিধা হয়নি। পরে অবশ্য মামলা হয়েছিল। কিন্তু আসিফের বাবার ক্ষমতার দাপটে সেটাও কয়েকদিনে নিষ্পত্তি হয়ে গিয়েছিল। মিডিয়া, জনতা কিছুদিন শোরগোল করলেও একসময় সব চুপচাপ হয়ে যায়।
.
-কী হলো মিঃ আসিফ? চুপ করে আছেন যে?
আসিফ স্বম্বিৎ ফিরে পায়। অতীত থেকে বাস্তবে ফিরে আসে। সেদিনের ঘটনাটারই পুনরাবৃত্তি ঘটেছে তিন বছর পর, ওর নিজের সাথেই। কিন্তু সে রাশেদ খানকে এতকিছু বলতে পারে না। শুধু রোবটের মতো ভাবলেশহীণ মুখে বলে যায়,
– ‘নিজের প্রিয়তম স্ত্রীকে চোখের সামনে অপদস্ত করলে, বেআব্রু করলে, সম্ভ্রমহানি করলে কেমন লাগে! অনুভূতিটা তোর জানা ছিল না। এজন্যই এই নাটকের আয়োজন। আর বাকিটা তোর পাপের শাস্তি। মহুয়া নামে কেউ নেই। ও একটা পতিতা, এ নাটকের ভাড়া করা অভিনেত্রী। এসবই, এসবই লেখা ছিল চিঠিতে।’
.
রাশেদ খানের কণ্ঠে চরম অবিশ্বাস আর বিস্ময় ফুটে উঠল।
-আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
মিসির আলি আসিফ বলল,
-আমি আপনাকে আপাতত এর বেশি কিছু বলতে পারছি না। আমাকে একটু একা থাকতে দিন।
.
এমন সময় ডাক্তার রুমে প্রবেশ করল। রাশেদকে বলল পরে আবার আসতে। এখন রোগীর বিশ্রাম দরকার। রাশেদ আসিফকে বলে,
-আবার দেখা হবে। পরে যখন আসবো তখন আশা করি সব খুলে বলবেন।
রাশেদ বেরিয়ে গেল। আসিফ(আসিফ) চোখের ব্যান্ডেজ ছুঁয়ে দেখছে। ভাবছে, চিরতরে অন্ধ হয়ে গেলেই ভালো হবে। এই মুখ সে আর কখনো আয়নাতে দেখতে চায় না।
.
রাশেদ কেবিন থেকে বেরোতেই আমজাদুর রহমানের সাথে দেখা হলো। তিনি জিজ্ঞেস করলেন,
-আসামীদের কখন গ্রেফতার করবেন ইন্সপেক্টর?
জবাবে সে বলে,
-আপনিই তো বলেছেন আপনার ছেলে চায় না কারও শাস্তি হোক। মনে হয় অপরাধীরা মুক্ত হয়ে ঘুরে বেড়াক এই দৃশ্যে সে অভ্যস্ত।
আমজাদুর রহমান রেগে গিয়ে বললেন,
-ও কী বুঝে! দু’দিনের ছেলে। অপরাধীকে ধরা তোমার কাজ। তুমি সেটা করো। সেটাই তোমার জন্য ভালো হবে।
রাশেদ হেসে বলল,
-তা তো অবশ্যই। আমি চেষ্টা করছি। এখন তাহলে আসি। পরে আবার দেখা হবে।
.
হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে রাশেদ মোবাইল কানে দিল। ওপাশের জনকে বলল,
-আসিফ মামলা করতে চাচ্ছে না। আমাদের উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। মনে হচ্ছে আত্ম-অনুশোচনায় ভুগছে। সে ছাড়া অন্য কারো বোঝার সাধ্য নেই এটা একটা পরিকল্পিত ঘটনা। চিন্তার কিছু নেই। আর বাকি সব আমি সামলে নিচ্ছি।
ওপাশ থেকে স্বস্তির নিশ্বাস শোনা গেল।
.
ফোনটা কেটে দিল রাশেদ। মনে হচ্ছে বুকের ওপর থেকে অনেক বড় একটা বোঝা নেমে গেছে। গত তিন বছর ধরে আত্মগ্লানি কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল ওকে। সেদিন কিছু করতে পারেনি। ইচ্ছে থাকলেও সাধ্য ছিল না ওর। ভীড় ঠেলে ঘটনাস্থলে যেতে যেতে সব শেষ হয়ে গিয়েছিল। সেদিনের সেই ভিকটিম মেয়েটি হাসপাতালেই মারা যায়। ওর স্বামী বেঁচে আছে, তবে মৃত মানুষের মতো। যেন একটা জীবন্ত লাশ। তাকে পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়েছে আজীবনের জন্য। তার সাথে পরিকল্পনা করে এবং তার সাহায্য নিয়েই রাশেদ এ সবকিছু করেছে।
হ্যাঁ রাশেদই এই নাটকটির পরিচালক। মহুয়া একজন পতিতা। তাকে মাস খানেকের জন্য ভাড়া করতে কোন কষ্টই হয়নি। পুলিশকে এমনিতেই ওরা সমীহ করে চলে। মহুয়ার তথাকথিত বাবাও একজন সাধারণ মানুষ, এ নাটকের আরেক অভিনেতা। তাকে তো আমজাদুর রহমান এমনিতেই নাটক থেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন। এতে রাশেদের সুবিধাই হয়েছে। নাহলে কাজটা তাকেই করতে হতো।
ছেলেগুলো সব নাট্যদলের। সেদিন ওরা মহুয়াকে ধর্ষণ করেনি। শুধু অভিনয় করেছিল। কম কষ্ট হয়নি রাশেদের সব ঠিকঠাক ভাবে বাস্তবায়ন করতে। ছেলেগুলো খুব ভয় পেয়েছিল। বারবার আশস্ত করতে হয়েছে রাশেদকে, ওদের কোন ক্ষতি হবে না। তাছাড়া ঘটনার সময় সবাই ছদ্মবেশে ছিল। তাই এখন আর কাউকে চেনা যাবে না। তবুও সাবধানতার জন্য সবাইকে কিছুদিনের জন্য গা ঢাকা দিয়ে থাকার নির্দেশ দিয়েছে রাশেদ।
এখন শুধু সিসিটিভি ফুটেজটা নষ্ট করতে হবে। তারপর একদিন এমনিতেই সব চুপ হয়ে যাবে। যেটা বরাবর হয়ে থাকে। নাটকের শেষদৃশ্য ভেবে রাশেদ হাসলো। হাসিটা এ সমাজ ব্যবস্থার প্রতি বিদ্রুপের হাসি।
সমাপ্ত, কেমন লাগল জানাবেন।
মিসির আলি সিরিজের বইগুলো পিডিএফ আকারে ডাউনলোড করে রাখুন। রিভিউ পরে দেওয়া হবে।