হুমায়ুন আহমেদের জনপ্রিয় চরিত্র গুলোর মধ্যে শুভ্র একটি। শুভ্র সিরিজের মোট ৬ টি বই।
শুভ্র সেসব মানুষদের মাঝে একজন যাদের হৃদয় শুভ্রের মতো সাদা । শুভ্র চরিত্রটি হিমু,মিসির আলী চরিত্রের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। লেখক শুভ্র সিরিজে প্রচুর চরিত্র তৈরি করে দিয়েছেন যাদের কারণে শুভ্রকে কম হাইলাইট করা হয়। বড়লোক পরিবারের সন্তান শুভ্র, চশমা ছাড়া ও চোখে দেখেনা। বন্ধু সার্কেলের সবাই তাকে কানাবাবা বলে ডাকে। সারাদিন বই পড়তে থাকে ও।
শুভ্র উপন্যাসগুলোতে রহস্যময়ভাবে পতিতার চরিত্র প্রায় দেখানো হয়।
শুভ্র আসলে মলাটের নামের মতো বনে যায় নি গেছে চরে, তার নাম শুভ্রে’র চর! তবে অনেকটা বনের মতোও বলা যায় কেননা দুটোই বিচ্ছিন্ন। শুভ্রের অন্য সিরিজের চেয়ে এতে পাত্র-পাত্রীর ভিড় বেশি। সেজন্য যেমনটি শুভ্র’র কাহিনী গুরুত্ব পেয়েছে তেমনি অন্যদেরও। বইটার মূলটা গেথে দিয়েছে ঠাসা ঠাসা চিঠি আর বহুমাত্রিকতায়। গল্পের মাঝে টুনুর লেখা ‘মাহিনের মৃত্যু’ যেন বোনাস পয়েন্ট!
full review 01
একশো ভাগ শুদ্ধ মানুষ কি আছে? হয়তো নেই। কিন্তু লেখকরা তো কল্পনাবিলাসী। তারা তাদের অনুভূতির ডানায় পাখা মেলে নানা কল্পনা এঁকে যান। কল্পনায় আঁকা এমনই একটি চরিত্র হলো শুভ্র। কল্পনার জাল হুমায়ূন আহমেদের মতো করে খুব কম লেখকই বুনতে পেরেছেন। মানুষের নানা দিক নিয়ে তিনি আলাদা আলাদা চরিত্র তৈরি করেছেন। মানুষের কল্পনাবিলাসী দিক নিয়ে তৈরি করেছেন হিমু। বিশ্লেষণধর্মী দিক নিয়ে তৈরি করেছেন মিসির আলী। আর মানুষের ভেতরকার নিষ্পাপ সত্ত্বাকে নিয়ে তৈরি করেছেন শুভ্র।
শুভ্র হুমায়ূন আহমেদের ব্যতিক্রমধর্মী এক চরিত্র। যে পৃথিবীর সব পাপ-পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত। একজন পাঠক যখন শুভ্র পড়েন তখন তিনি উপলব্ধি করেন তার মাঝেও একটা শুভ্র বাস করে। কিন্তু বাস্তবতার অজুহাতে, বেঁচে থাকার তাগিদে কিংবা নিছক লোভে পড়ে সেই শুভ্রকে ধীরে ধীরে অন্ধকার কালোয় ঘিরে ফেলি।
তবে শুভ্র চরিত্রটিকে লেখক এই প্রথম তার খোলস থেকে বের করে এনেছেন, সেটাই এই উপন্যাসের সবচেয়ে বড় প্লাস পয়েন্ট এবং সেই কারণেই শুভ্র সিরিজের সাথে পূর্ব পরিচয় ছিল এমন পাঠকদের কাছে কিছু কিছু ক্ষেত্রে উপন্যাসটি আনপ্রেডিক্টেবল হয়ে উঠবে। যেমন আমি।
‘শুভ্র গেছে বনে’র বিশেষত্ব নিয়ে যদি বলতে বলা হয়, তাহলে প্রথমেই আমার মাথায় আসবে এই উপন্যাসে সংযোজিত একাধিক চিঠি। অনেকগুলো চিঠির দেখা মিলবে এই উপন্যাসে। একটি প্রকৃত চলচ্চিত্রের কাহিনী এগিয়ে নিতে গান যেমন কার্যকরী ভূমিকা পালন করে, ঠিক তেমন ভূমিকাই এই উপন্যাসে নিয়েছিল ঐ চিঠিগুলো। প্রতিটি চিঠির ভাষাকে লেখক চিঠির লেখকের চরিত্রের সাথে সামঞ্জস্য রেখে তৈরি করেছেন বলে চিঠিগুলো বাস্তবসম্মত হয়েছে এবং উপন্যাসকে বেশ ভালোভাবেই প্রভাবিত করেছে।
শুভ্র সিরিজের আগে পরের যেকোন বইয়ের তুলনায় এই বইয়ে চরিত্র সংখ্যা অনেক বেশি। অসংখ্য চরিত্রের ভীড়ে শুভ্রের উপস্থিতি তাই নিতান্তই নগন্য। শুভ্র ভক্তদের কাছে এটা খারাপ লাগতে পারে। কিন্তু একটি একক উপন্যাস হিসেবে যদি ‘শুভ্র গেছে বনে’কে বিবেচনা করা হয়, তাহলে মানতেই হবে যে লেখক সমান মমতার সাথে প্রতিটি চরিত্রকে গঠন করেছেন এবং তাদের গল্প তুলে ধরেছেন যে কারণে এটি একটি স্বয়ংসিদ্ধ উপন্যাসে পরিণত হয়েছে।
শুভ্রকে নিয়ে লেখা আগের উপন্যাসগুলোর ব্যাপ্তি খুবই কম। সেজন্য সেগুলোকে উপন্যাস না বলে উপন্যাসিকা বলাই শ্রেয়। কিন্তু ‘শুভ্র গেছে বনে’ বাস্তবিকই একটি পরিপূর্ণ উপন্যাস
এ উপন্যাসে শুভ্রকে দেখা যায় একদম অন্য রূপে। রাস্তায় পাওয়া অসহায় মেয়েকে সাহায্য করার জন্য সে বাড়িতে নিয়ে আসে। মেয়েটিকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হলে সে-ও বের হয়ে যায়। কারণ সে মনে করে মানবজাতি এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। একজনের কিছু হলে আরেকজনকে এগিয়ে আসতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। বাড়ি থেকে বের হয়ে সে এক পতিতার সাথে পরিচিত হয়। যে তাকে ভাই ডাকে। তার সাথে সে পদ্মায় জেগে উঠা নতুন পাড়ে চলে যায়। চরের কোনো নাম এখনও দেয়া হয়নি। শুভ্র সেখানেই থাকে। সেখানে সে একটা স্কুল গড়ে তুলেছে। প্রতি সপ্তাহে সে সায়েন্সের বক্তব্য দেয়। চরের মানুষ তাকে ভালোবাসে। সবাই তাকে ডাকে ধলা মিয়া। গায়ের রঙ ফর্সা বলে এই নাম। ধীরে ধীরে এই চরের নাম হয়ে উঠে ‘শুভ্রর চর’। একজন অজানা মানুষ কীভাবে সবার এতো আপন হয়ে উঠলো যে তার নামই হয়ে গেলো চরের নাম। মনের শুভ্রতার বুঝি এমনই শক্তি। এভাবেই হুমায়ূন আহমেদের সৃষ্ট ‘শুভ্র’ আমাদের ভেতরকার কিছু একটা কোথায় যেন নাড়া দিয়ে যায়।
সংক্ষেপণ 02 :
যুথীর ভাষ্য মতে শুভ্র একটি গাধামানব! বলবেই না কেন! হাঙ্গামায় গাড়ি, টাকাপয়সা এবংকি চশমাও হাড়িয়েছে! তাই বাড়ি যেতে পাড়ছে না। গাড়ি কিমবা টাকা ছাড়া ওর চলে তবে চশমা ছাড়া ও প্রায় অন্ধ। সেজন্য অনেকক্ষণ যাবৎ যুথীর সাথে আছে, যুথীর কাছে এটা ঝামেলার মতো মনে হচ্ছে। শুভ্রের বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা নিতান্ত কম, তবে যুথী অত্যন্ত চতুর ও জীবন সংগ্রামি। যুথীর উপোকারে পুরষ্কার সরূপ শুভ্র’র বাবা তাকে কিছু ফলমূল পাঠায় আর শুভ্র দেয় হারমোনিয়াম তবে তা কৃতজ্ঞতায় নয় তার কন্ঠে মুগ্ধতায়। এদিকে লাইলি নামক মেয়েকে যুথীর ভাই বিয়ে করে উধাও হয়ে যায়, মেয়েটি দিশেহারা হয়ে ছিল। সেজন্য লায়লাকে শুভ্র’র বাড়িতে নিয়ে গেল, তবে তার মা-বাবা তাদের দুজনকেই বাড়ি থেকে বেড় করে দেয়।
আসলে শুভ্র’র বাবার ধারণা ছিল শুভ্র কিছুক্ষণ পর কাদঁতে কাদঁতে ফিরে আসবে। তবে বাস্তবে এমনটা হলো না, সে নীপার বাসায় লাইলিকে রেখে নিজে রাস্তায় নামে। পার্কে পরিচয় হয় মর্জিনা নামের মেয়ের সাথে, শুভ্রর সরলতায় মুগ্ধ হয়ে তাকে নিজের বাড়ি নিয়ে খাওয়ায় এবং তাদের দারিদ্রতার সাথে পরিচয় হয়্ । তখন শুভ্র তাদের সঙ্গে অজানা চরে যায়। এজীবনের সাথে শুভ্র’র পরিচয় ছিল না, তবে সে অল্পতেই সেখানে বিখ্যাত হয়ে গেল, এবংকি চরের নামও হয়ে গেল শুভ্রের চর। কোন উপায় না দেখে শুভ্রকে আনতে তার বাবা যুথীকে পাঠালো এবংকি তিনি নিজেও হেলিকপ্টারে চেপে আসলেন। এসেই শুনে শুভ্র’র জয়ধ্বনি!
হুমায়ুন আহমেদ (২০১০)-
” শুভ্রর মতো কাউকে কি আমি ছিনি, যাকে এই বই উৎসর্গ করা যায়? না, ছিনি না। প্রকৃতি শুদ্ধতম মানুষ কখনে তৈরি করে না।কিছু না কিছু খাদ ঠুকিয়ে দেয় “