অনেকে প্রশ্ন করেন- ‘২০২৩ বইমেলায় আপনার কি নতুন কোন বই প্রকাশিত হবে?’
আরিফ আজাদ বলেন- অনেক অনেক পাঠকের কাছ থেকে এই প্রশ্নটা পেয়ে আসছি এতোদিন। প্রশ্নটার উত্তর হিশেবে ‘জি, প্রকাশিত হবে’ বললেও, বইটার নাম কী হবে, বইটা কোন বিষয়ের ওপর লেখা, কোন প্রকাশনি থেকে আসবে— এসবের কিছুই জানানো যায়নি। আলহামদুলিল্লাহ, সেই উত্তরগুলো নিয়ে হাজির হয়েছি এবার। যারা আমার লেখা নিয়মিত পড়েন তাদের জানা থাকবার কথা যে— দুই-আড়াই বছর ধরে কুরআন নিয়ে আমি তিনটা সিরিজ লিখছি, আলহামদুলিল্লাহ।
সিরিজ তিনটি হলো— কুরআন থেকে নেওয়া জীবনের পাঠ’, আমার কাহাফ ভাবনা এবং সূরা ইউসুফ থেকে আমি যা শিখেছি।
সিরিজগুলোর বেশকিছু লেখা আমি ফেইসবুকেও আর্টিকেল আকারে পোস্ট করেছি। সেই সিরিজগুলো নিয়ে পাঠকের উচ্ছ্বাস কাজগুলোকে এগিয়ে নিয়ে যেতে আমাকে দারুনভাবে উদ্দীপ্ত করেছে, আলহামদুলিল্লাহ।
চলমান এই সিরিজ তিনটা থেকে কুরআন থেকে নেওয়া জীবনের পাঠ’ pdf সংস্করণ ব্যতীত হার্ডকপি আকারে আগামি একুশে বইমেলা ফেব্রুয়ারি- ২০২৩ এ প্রকাশ হবে, বিইযইনিল্লাহ। বইটা প্রকাশিত হবে ইসলামি ধারার সৃজনশীল প্রকাশনি সত্যায়ন প্রকাশন থেকে।
‘কুরআন থেকে নেওয়া জীবনের পাঠ’— বইয়ের মূল প্রতিপাদ্য কী, তাই তো?
জীবনের সাথে কুরআনের সম্পর্কের বুনন তৈরির একটা ক্ষুদ্র প্রচেষ্টার ফসল এই বই। সবটাই কা’বার মালিকের দয়া আর রহমত৷ ফালিল্লাহিল হা’মদ!
কুরআন কীভাবে আমাদের জীবনের কথা বলে, কীভাবে ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে যায় আমাদের জীবনের অনুষঙ্গে, কীসব রত্নের আকর কুরআন আমাদের সামনে তুলে ধরে— সেসবের এক জীবনঘনিষ্ঠ রচনা।
ইন শা আল্লাহ, বইমেলায় প্রকাশিত হবে। প্রকাশ করবে স্বনামধন্য প্রকাশনি সত্যায়ন প্রকাশন
আপনাদের দুআ, ভালোবাসা আর পরামর্শের হিতাকাঙ্ক্ষী 💚
326212449 710779370457816 1355208800081424457 n

কুরআন থেকে নেওয়া জীবনের পাঠ’ বই রিভিউ

এককথায়— কুরআন কীভাবে আমাদের জীবনের কথা বলে, কীভাবে আমাদের জীবনে কুরআন হয়ে উঠতে পারে আলোর দিশা, কুরআনের আয়াতগুলো থেকে কীভাবে আমরা আহরণ করতে পারি মণি-মুক্তো, কীভাবে কুরআন আমাদের চিন্তার জগতে আনতে পারে নতুন মাত্রা— পাঠক পরিচিত হবে সেরকম একটা ধারার সাথে। উঁহু, গতানুগতিক গদ্য বা খটমটে প্রবন্ধ নয়, প্রতিটা অধ্যায়ে পাঠক দেখতে পাবে তার জীবনের প্রতিচ্ছবি, জীবন থেকে নেওয়া ঘটনা অথবা চারপাশের চিরচেনা জগতের সাথে কুরআন কীভাবে ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কিত। জীবনের গল্প পড়তে পড়তে পাঠক ঢুকে পড়বে কুরআনের ভাবনার জগতে, সেই জগত থেকে আলো ধার করে পাঠক আবার ফিরে আসবে জীবনের ধারায়— বইটা সাজানো ঠিক এভাবেই, আলহামদুলিল্লাহ।
তাহলে— এটা কি কোন তাফসিরের বই? মোটেও তা নয়। সেই যোগ্যতা আমার নেই। তবে— সমস্ত ভাবনাগুলোই প্রসিদ্ধ সব তাফসিরের সারনির্যাস যা জীবনোপোযোগি ঢঙে বর্ণনা করা।

সূচিপত্র

আগ্রহী পাঠকদের জন্যে নিচে প্রকাশিতব্য বইটার শিরোনাম দেওয়া হলো:
.
১. দুঃখের আলপনায় স্বস্তির রং
২. ঝরা পাতার কাব্য
৩. যখন নেমে আসে আঁধারের রাত
৪. ব্যাকুল হৃদয়ের আকুল সঙ্গীত
৫. ছুটে আসে আগুনের ফুলকি
৬. নীল দরিয়ার জলে
৭. এ-সময় শীঘ্রই ফুরিয়ে যাবে
৮. যে আঁধারের রং নীল
৯. আকাশের খাতায় লেখা লজ্জার নাম
১০. ফিরআউন সিনড্রোম
১১. চাঁদে যারা জমি কিনছেন
১২. ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বালুকণা, বিন্দু বিন্দু জল
১৩. নূহের প্লাবন এবং ভাবনার অলিগলি
১৪. অন্তর মাঝে হিয়ার আলো
১৫. আল্লাহকে যারা পাইতে চায়
১৬. প্রেমময় কথোপকথন
১৭. অন্তরের ব্যাকরণ
১৮. সোনার তোরণ পানে
১৯. প্রবল প্রতাপশালী তবু মহীয়ান
২০. অন্তর মম বিকশিত করো
২১. আলো অথবা অন্ধকার
২২. তারা কভু পথ ভুলে যায় না
২৩. চালাও সে পথে যে পথে তোমার প্রিয়জন গেছে চলি
২৪. জীবনের বেলা শেষে
২৫. অন্তর বাঁচানোর মন্তর
২৬. তোমার প্রতিবেশী করে নিয়ো
২৭. একজন কথা রাখেন
২৮. ভীষণ একলা দিনে
এই বই যদি অন্তত কিছু মানুষের অন্তরে কুরআন-বসন্ত আনে, যদি একজনকেও নিয়ে আসে কুরআনের আরো কাছাকাছি, তাহলেই কাজটা সার্থক হবে, ইন শা আল্লাহ। কবুল করার মালিক মহান রব৷ আকাশের মালিকের দরবারে আকুল ফরিয়াদ— তিনি যেন আমার কাজটাকে কবুল করেন।
বরাবরের মতো আপনাদের সকলের ভালোবাসা, দুয়া আর পরামর্শের হিতাকাঙ্ক্ষী 💚
আসলে এই সম্পর্কে লেখার মত লেখকের খুবই অভাব সমাজে, যার কারণে মানুষের কুর‘আনের প্রতি অনিহা বিরাজ করে। যদি এই সম্পর্কিত বেশিরভাগই বই হতো, তাহলে হইতো কুর‘আনের প্রেমিকরাই সমাজে বেশি হতো, কুর‘আনের প্রতি এত নির্মম আচরণ হতো না, কুর‘আনের আলোয় আলোকিত হতো। তাই সকল লেখকের প্রতি উদাত্ত আহ্বান থাকবে এই সম্পর্কিত বইয়ের দিকে মনোনিবেশ করতে। সেজন্য আরিফ আজাদ ভাইয়ের জন্য আল্লাহর নিকট উত্তম জাযা প্রার্থনা করি। আল্লাহ তাঁকে কবুল করুন। আল্লাহ তাঁকে সঠিক আক্বীদা এবং মানহাযের উপর প্রতিষ্ঠিত রাখুন।

1

‘গোটা সৃষ্টিজগতে এমন একটা বিন্দু, এমন একটা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বস্তুকণা নেই যা তাঁর দৃষ্টির অন্তরালে। সাগরের বুকে তৈরি হওয়া একটা ছোট্ট ঢেউ, সেই ঢেউয়ের আরো ভিতরে তৈরি হওয়া কম্পন, সেই কম্পনে ছিঁটকে যাওয়া একবিন্দু জল— সেই ঘটনাচিত্রও আল্লাহর দৃষ্টির আড়াল হতে পারে না।
গভীর সাগরতলে যে ক্ষুদ্র নুড়িকণা, সেই নুড়িকণার নিচে তার চেয়েও ক্ষুদ্র যে প্রাণী, সেই প্রাণীর গায়ে থাকা তারচেয়েও ক্ষুদ্র বালিকণা— সেটাও আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা দেখেন।
ঘন গহীন অরণ্য, যেখানে আজতক কোন মানুষের পদচিহ্ন পড়েনি, গাছেদের ডালপালার ঘনত্বকে ফুঁড়ে যেখানে পৌঁছাতে পারে না সূর্যের প্রখর রশ্মি, প্রকাশ্য দিবালোকেও অন্ধকারে ডুবে থাকা সেই জঙ্গলের একেবারে অবহেলিত কোণে বেড়ে উঠা একটা ছোট্ট আগাছা, যার ডগায় আজ নতুন একটা কুঁড়ি বের হয়েছে, যে কুঁড়ির সন্ধান হয়তো কোনোদিন কোন মৌমাছি পাবে না, যে কুড়ি থেকে প্রস্ফুটিত ফুলে কোনোদিন বসবে না কোন প্রজাপতি— সেই অজানা, অবহেলিত ফুলও আল্লাহর দৃষ্টির অন্তরালে নেই।’
323404134 530237359139390 9133238768183147764 n

2

কুরআনের দুআগুলো আমাকে বেশ আশ্চর্যান্বিত করে। যেন সেগুলো তাকওয়া, তাওয়াক্কুল আর ঈমানের জোয়ারে টইটম্বুর। ঠিক এমনই একটা দুআর দেখা মিলে সূরা আল-বাকারায়, যা আল্লাহর কাছে করেছিলেন আমাদের পিতা ইবরাহীম আলাইহিস সালাম।
পুত্র ইসমাঈলকে সাথে নিয়ে যখন তিনি কা’বার ভিত্তিপ্রস্তর পুনরায় স্থাপন করলেন, ঠিক সেই মুহূর্তেই তিনি এই দুআটা করেন।
দুআটার ভেতরে যাওয়ার আগে আমি আপনাদের একটা দৃশ্যের সামনে দাঁড় করাতে চাই। ধরা যাক বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী শাসকের কাছ থেকে আপনাকে একটা কাজ দেওয়া হলো। কাজটা হলো—তারা নির্মাণ করবে দুনিয়ার সবচেয়ে বড় দালান, যা হার মানাবে বুর্জ আল-খলিফাকেও! মহা এই কাজের দায়িত্ব দুনিয়ার আর কেউ নয়, পেয়ে গেছেন আপনি!
এমন একটা কাজের মহা-দায়িত্ব যদি আপনি আজ রাতে পেয়ে যান, ভাবুন তো আপনার চারপাশে কেমন হইচই পড়ে যাবে? আপনার ফেইসবুক-ইন্সটাগ্রাম-টুইটারসহ সকল সোশ্যাল মিডিয়ায় কী অভাবনীয় কাণ্ড ঘটবে, তা কি আপনি ভাবতে পারেন? এই ঘটনা যখন আপনি সোশ্যাল মিডিয়ায় জানাবেন, তখন লাখ লাখ মানুষ আপনাকে অভিনন্দন আর শুভেচ্ছা জানাবে। রাতারাতি আপনি হয়ে যাবেন মহা-সুপারস্টার! আপনার পা তখন আর মাটিতে থাকবে না।
এমনই এক মহা-প্রজেক্টের দায়িত্ব পেয়েছিলেন ইবরাহীম আলাইহিস সালাম। প্রায়-বিলীন হয়ে যাওয়া পৃথিবীর সর্বপ্রথম গৃহ কা’বাকে পুনরায় নির্মাণের এক মহা-দায়িত্ব আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা অর্পণ করেছেন তাঁর ওপর। সেই দায়িত্বে যখন তিনি হাত লাগালেন, তখন নিজের পুত্রকে সাথে নিয়ে তিনি আল্লাহর কাছে হাত তুলে বললেন :
رَبَّنَا تَقَبَّلْ مِنَّا ۖ إِنَّكَ أَنۡتَ السَّمِيۡعُ الْعَلِيۡمُ ‎١٢٧
“হে আমাদের প্রতিপালক! (এই কাজটাকে) আপনি আমাদের পক্ষ থেকে কবুল করুন। নিশ্চয়ই আপনি সর্বশ্রোতা এবং সর্বজ্ঞ।”
পৃথিবীর সবচেয়ে হাই-রেইজ বিল্ডিংয়ের ভিত্তিপ্রস্তর যখন স্থাপন করতে যাবেন, তখন নিশ্চয় মুহুর্মুহু ক্যামেরার ক্লিকে বন্দী হয়ে পড়বেন আপনি। সেলফিতে, ফটোতে, ভিডিওতে দুনিয়ার সকলকে জানাতে আপনি মরিয়া হয়ে উঠবেন যে—কী বিরল সম্মানের অধিকারী আপনি হয়েছেন!
আপনি লিখবেন—‘Yes, I’ve done it! Hurrr re…’
পত্রিকাগুলো আপনাকে নিয়ে ফিচার ছাপবে, চ্যানেলগুলো আপনাকে নিয়ে সিরিজ-প্রোগ্রামের আয়োজন করবে। সবকিছুকে ঘিরে আপনার তখন সে কী উন্মাদনা!
কিন্তু কা’বা, যেটা দুনিয়ার সবচাইতে সম্মানিত এবং পবিত্র ইবাদাত-গৃহ, সেই গৃহের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের দায়িত্ব পেয়ে ইবরাহীম আলাইহিস সালাম উন্মত্ত উল্লাসে ফেটে পড়েননি। তিনি মক্কা থেকে মিশরে এসে তাঁর কওমকে জানাননি যে—‘জানো, আমি কিন্তু কা’বা গৃহ নির্মাণের দায়িত্ব পেয়েছি! কা’বা গৃহ কী তোমরা জানো? সেটা হলো আল্লাহর পবিত্র ঘর! দুনিয়ার বুকে নির্মিত সর্বপ্রথম ইবাদাত-গৃহ!’
এমন সম্মানের অধিকারী হয়ে তিনি মিশরে মাস-ব্যাপী মনোজ্ঞ অনুষ্ঠানের আয়োজনে মত্ত হয়ে যাননি। তিনি দুনিয়া-ব্যাপী ঘোষণা দেননি তার অর্জনের। বরং দায়িত্বটা পেয়ে তিনি আল্লাহর কাছে হাত তুলে বললেন যেন মহামহিম রব তার কাজটাকে কবুল করে নেন।
কিন্তু এখানে কবুল করার প্রশ্নটা এলো কেন? এই কাজের জন্য আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলাই তো ইবরাহীম আলাইহিস সালামকে মনোনীত করেছেন। এই দায়িত্ব আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাঁর ওপর অর্পণ করেছেন। তিনি যদি তাঁকে ‘যোগ্য’ মনে না-ই করতেন, তাহলে দায়িত্বটা তো তাঁকে দিতেন না। তবে কেন ইবরাহীম আলাইহিস সালাম কাজটা করতে গিয়ে অনুনয়-বিনয় করে, কাতর গলায় বললেন—‘আল্লাহ, আমাদের পক্ষ থেকে কাজটাকে আপনি কবুল করে নিন’?
এটাই হচ্ছে বিনয়। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার ক্ষমতার প্রতি প্রশ্নাতীত আনুগত্য।
ইবরাহীম আলাইহিস সালাম খুব ভালো করেই জানেন যে—আল্লাহর সাহায্য আর দয়া না থাকলে এই কাজ তিনি কোনোদিনও সমাপ্ত করতে পারবেন না। এই কাজ করার যে যোগ্যতা তাঁর মাঝে আছে, তার পুরোটাই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা প্রদত্ত। তিনি নিজ থেকে কোনোকিছুই করার ক্ষমতা রাখেন না। এবং যেহেতু তিনি মানুষ, তাই কাজটা করতে গিয়ে তাঁর ভুলত্রুটি হতে পারে। সমস্ত ত্রুটিকে, সমস্ত ভুলকে ক্ষমা করে দিয়ে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা যেন তার কাজটাকে কবুল করেন এটাই তাঁর আর্জি।
যে শাসক আপনাকে দুনিয়ার সবচেয়ে উঁচু দালান নির্মাণের দায়িত্ব দেন, তার সামনে গিয়ে আপনি কি এটা কখনোই বলবেন যে—‘আপনার কাজটা করতে গিয়ে আমার খানিকটা এদিক-সেদিকও হতে পারে। আপনাকে হান্ড্রেড পার্সেন্ট কাজ বুঝিয়ে দিতে পারবো—এমন কোনো কথা নেই কিন্তু।’
আপনি এভাবে বলেন না। আপনি জানেন এভাবে বলতে গেলে দুনিয়ার মানুষেরা আপনার দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠাবে। তাদের মনে সন্দেহ দানা বাঁধবে আপনার যোগ্যতা নিয়ে। তাদের সামনে আপনাকে থাকতে হয় প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী। আপনাকে বলতে হয়—‘এই টাইপ কাজ তো আমি কতো অনায়াসেই করে ফেলি। আমার অমুক প্রজেক্ট দেখেন, তমুক প্রজেক্টের ব্যাপারে খোঁজ নেন দরকারে।’
বসের কাছে নিজের এক্সেলেন্সি প্রমাণে আপনি তখন মরিয়া হয়ে উঠবেন। কোনো কাজ শুরুর পূর্বে অথবা শুরু করতে গিয়েই যদি আপনি নিজের পক্ষ থেকে সামান্য ত্রুটির আশঙ্কাও প্রকাশ করে ফেলেন, দুনিয়ার কোনো বস-ই সেটাকে ভালোভাবে গ্রহণ করবে না।
কিন্তু আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার কাছে ব্যাপারটা পুরোপুরিই অন্যরকম। আপনার সমস্ত অক্ষমতা, অদক্ষতা, অপারগতা আর কেউ জানুক বা না-জানুক, আল্লাহর কাছে তা কি আদৌ কোনোভাবে গোপন থাকে? তিনি অবশ্যই জানেন যে আপনার আসলে বড়াই করার মতো কোনো যোগ্যতা নেই। আপনি যেটাকে নিজের ‘যোগ্যতা’ ভাবেন, তা আসলে আল্লাহর ‘দয়া’। তিনি দয়া করেন বলেই আপনি কাজটা ভালো পারেন।
আল্লাহর এই অনুগ্রহকে ইবরাহীম আলাইহিস সালাম অনুভব করেছিলেন বলেই পবিত্র কা’বা ঘর নির্মাণের দায়িত্ব পেয়েও তিনি অহংকারে ফেটে পড়ার বদলে বিনয়াবনত হয়েছিলেন। ওই একই দুআয় তিনি বলেছিলেন—‘নিশ্চয়ই আপনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।’
বান্দার সকল কাজে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার যে নিরন্তর তদারকি, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কোনো বিষয়ই যে আল্লাহর কাছে গোপন করা যায় না, এতো বড় সম্মানের অধিকারী হওয়ার পরেও ইবরাহীম আলাইহিস সালাম আল্লাহর এই গুণের কথা ভুলে বসেননি। কোনো কাজে আপনি কতোটুকু হেলাফেলা করেন তা কেবল নয়, হেলাফেলা করার ভাবনা যখন আপনার অন্তরে উদয় হয়, ওই ভাবনাটাও আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার কাছে গোপন থাকে না।
আমি আশ্চর্য হয়ে ভাবী—স্বীকৃতি লাভের পর আনন্দের আতিশয্যে যেখানে মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়ে, সেখানে নবি-রাসূলগণ কী সুন্দর সংযম আর বিনয়ের দীক্ষাই না আমাদের দিয়ে গেলেন!

'কুরআন থেকে নেওয়া জীবনের পাঠ' বই

3

সূরা ফালাক তিলাওয়াতকালে প্রতিবারই আমি একটা ধাক্কা খাই। সূরা ফালাকের একেবারে শেষ আয়াতে, কোন জিনিস থেকে আমরা আল্লাহর কাছে পানাহ চাই বলতে পারেন? হিংসুকের হিংসা থেকে। ওই আয়াতে আমরা বলি—
وَمِنۡ شَرِّ حَاسِدٍ إِذَا حَسَدَ ‎٥‏
“(আমি আশ্রয় প্রার্থনা করছি) হিংসুকের অনিষ্ট থেকে, যখন সে হিংসা করে।”
আমি অবাক হয়ে ভাবি—এই সূরায় মানুষ ক্ষতিকর প্রাণী, কীটপতঙ্গ, অন্ধকারের যা কিছু অনিষ্ট এবং যারা কুফরি-কালাম তথা ব্ল্যাক ম্যাজিক করে তাদের কাছ থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করে। একেবারে শেষে এসে বলে—‘আমাকে আশ্রয় দিন হিংসুকের অনিষ্ট থেকে, যখন সে হিংসা করে।’
যার অন্তরে ‘হাসাদ’ তথা হিংসা আছে তাকে কুরআন ক্ষতিকর প্রাণী, ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ এবং মানুষের ক্ষতি সাধন করে এমন জাদুকরদের সাথে সমান্তরালে রেখে কথা বলেছে। অর্থাৎ—হিংসুক ব্যক্তি ক্ষতিকর প্রাণী, কীটপতঙ্গ কিংবা জাদুকরদের চেয়ে কম ক্ষতিকর নয়!
ধরুন—আপনার অন্তরে হিংসা আছে। আপনি কারও উন্নতি দেখে সহ্য করতে পারেন না। কারও পদোন্নতি, ভালো অবস্থা দেখলে আপনার মন খচখচ করে। কারও ভালো কোনো অর্জন দেখলে আপনি তা মেনে নিতে পারেন না। মনে মনে আশা করেন—এই অর্জন যেন ধুলোয় পর্যবসিত হয় কিংবা এটাই যেন তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়।
আপনার অন্তরের অবস্থা যদি এরকম হয়, তাহলে সূরা ফালাকের শেষের সেই আয়াত, যে আয়াতে ‘হিংসুকের হিংসার অনিষ্ট’ থেকে পানাহ চাওয়া হয়, আপনিও সেই আয়াতের অন্তর্ভুক্তদের একজন।
অর্থাৎ—কেউ যখন আল্লাহর কাছে হিংসুকের হিংসার অনিষ্ট থেকে পানাহ চায়, তখন সে মূলত আপনার থেকেই আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করে। হিংসা করার মাধ্যমে তার যে ক্ষতি আপনি করে দিতে পারেন, সেই ক্ষতি থেকে সে বাঁচতে চায়।
মানুষেরা রোজ রোজ, সকাল-সন্ধ্যায় প্রার্থনা করে আপনার কাছ থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাচ্ছে—দৃশ্যটা ভাবতে কেমন লাগে আপনার?
‘হাসাদ’ তথা হিংসা অন্তরের এমন একটা মারাত্মক ব্যাধি যা আমাদেরকে ক্ষতিকর জিন, হিংস্র প্রাণী এবং ক্ষতিকর কীটপতঙ্গের কাতারে নামিয়ে আনে। এটা মানুষকে এমন স্তরে নামিয়ে আনে, যে স্তরে নেমে আসার পর অন্য মানুষদের আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাওয়া লাগে তার ক্ষতি থেকে বাঁচতে।
324509369 434695438782992 7791724437583838058 n
২০২৩ সালে প্রকাশিতব্য ‘কুরআন থেকে নেওয়া জীবনের পাঠ’ বই থেকে নেওয়া টুকরো অংশ। ইন শা আল্লাহ, বইটি প্রকাশিত হবে সত্যায়ন প্রকাশন থেকে…

4

নূহ আলাইহিস সালাম তাঁর কওমকে অনেক অনেক বছর দ্বীনের দাওয়াত দেন। কিন্তু অবাধ্য কওম তাঁর ডাকে কোনো সাড়াই দিতে চায় না। তারা আল্লাহর নবি নূহ আলাইহিস সালামকে অত্যাচার-নির্যাতন করে, তাঁর দাবিকে অস্বীকার করে এবং তাঁর নুবুওয়াতের ব্যাপারে যা খুশি তা বলতে থাকে। অবাধ্যতার চূড়ান্ত প্রকাশ যাকে বলে! তাদের সেই ক্রমাগত অত্যাচার-নির্যাতন, নিরন্তর অবাধ্যতা এবং সীমা লঙ্ঘনের কারণে তাদের ওপর আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার আযাব আসাটা অবশ্যম্ভাবী হয়ে দাঁড়ায়।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা নূহ আলাইহিস সালামকে একটা নৌকা বানানোর আদেশ দিলেন। তাঁর চূড়ান্ত ফায়সালা—বানের পানিতে তিনি ডুবিয়ে মারবেন এই অবাধ্য জাতিটাকে!
নৌকা বানানোর কাজে লেগে পড়লেন নূহ আলাইহিস সালাম। কিন্তু এমন কড়কড়ে রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিনে, এমন শুষ্ক আবহাওয়ার সময়ে বানের পানি থেকে বাঁচতে নৌকা বানাতে দেখে নূহ আলাইহিস সালামকে ঠাট্টা করতে শুরু করেছিলো কাফিরেরা।
وَيَصْنَعُ الْفُلْكَ وَكُلَّمَا مَرَّ عَلَيْهِ مَلَأٌ مِّنۡ قَوْمِهِ سَخِرُوۡا مِنْهُ ۚ
“নূহ নৌকা তৈরি করছিলো। আর যখনই তার জাতির প্রধান ব্যক্তিরা নূহের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলো, তারা তাঁকে নিয়ে উপহাসে মেতে উঠছিলো।” (১)
তাদের মনে হয়তো এই ভাবনার উদয় হয়েছিলো যে—আরেহ! কী সুন্দর আবহাওয়া প্রকৃতিতে বিরাজ করছে, আর এই লোকটা এসেছে আমাদেরকে বানের জলের গল্প শোনাতে! পাগল নাকি!
তারা হয়তো আরও ভেবেছে—ধরে নিলাম অঝোর ধারার বৃষ্টি হবে। কিন্তু তাই বলে কী নৌকায় উঠে সেই বৃষ্টি থেকে বাঁচতে হবে আমাদের? আমাদের ঘরগুলো কি ডুবে যাবে নাকি? এমনটা হয়েছে কখনো? এমন ঘটনা না আমরা দেখেছি আর না আমাদের বাপ-দাদারা দেখেছে কোনোদিন!
ভাবনা মিথ্যে নয়। নূহ আলাইহিস সালামের কওম কেবল নয়, তাঁর আগের কোনো জাতিই এতো ভয়াবহতম বন্যা অবলোকন করেনি এবং কিয়ামতের আগে হয়তো আর কোনো জাতি সেটা অবলোকন করবে না। যেহেতু এমনকিছু যে ঘটতে পারে সেই অভিজ্ঞতা তাদের কাছে ছিলো না, তাই নূহ আলাইহিস সালামকে এমন কড়কড়ে রোদে কাল্পনিক বৃষ্টি আর বন্যার কথা ভেবে নৌকা বানাতে দেখে উপহাস করতে শুরু করে তারা।
তাফসীর থেকে জানা যায়—নূহ আলাইহিস সালাম গোটা একশ বছর ধরে সেই নৌকা বানিয়েছিলেন। অর্থাৎ—যেদিন থেকে নূহ আলাইহিস সালাম সেই নৌকা বানানো শুরু করেছিলেন, তার আরও একশ বছর পর আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার আযাবের সেই বন্যা নূহ আলাইহিস সালামের কওমকে গ্রাস করেছিলো।
এই জায়গায় একটা চমৎকার ব্যাপার আমার মাথায় এলো। সেই নৌকাটা বানাতে যেহেতু নূহ আলাইহিস সালামের একশ বছর লেগেছিলো, তাহলে গোটা একটা শতাব্দী ধরে কাফিরদের ঠাট্টা-মশকারি, লাঞ্ছনা আর উপহাস তাঁকে কি সহ্য করে যেতে হয়নি? অবশ্যই হয়েছে। যদি রাতারাতি সেই আযাব চলে আসতো, যদি নূহ আলাইহিস সালাম নৌকা বানানোর কাজে হাত দেওয়া মাত্রই প্রকৃতিতে নেমে আসতো অঝোর ধারার বর্ষণ, তাহলেও নূহ আলাইহিস সালামের সতর্কবার্তাকে খানিকটা হলেও সত্য মনে করতো তারা। খুব বেশি উপহাস করতে পারতো না। কিন্তু গোটা একশ বছর যেখানে লেগে গেলো, এতো লম্বা একটা সময় ধরে যে উপহাস, বিদ্রুপ আর তিরস্কারের ভেতর দিয়ে নূহ আলাইহিস সালামকে যেতে হয়েছে তা কি কল্পনা করা যায়?
কিন্তু দেখুন—সেই লাঞ্ছনা, গঞ্জনা, উপহাস, বিদ্রুপ আর তিরস্কারের বিপরীতে কী সীমাহীন ধৈর্যের পরীক্ষা দিয়ে গেলেন নূহ আলাইহিস সালাম! ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাওয়া বলে একটা কথা আছে। নূহ আলাইহিস সালামের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙা তো দূর, কখনো সেই বাঁধের একটা বালুকণাও নড়চড় করেনি।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার প্রতিশ্রুত আযাব আসতে এতো সুদীর্ঘ সময় লেগে গেলেও, তিনি কখনোই প্রশ্ন করে বসেননি যে—ইয়া আল্লাহ, আপনি তো বলেছেন এই কাফিরদের জন্য আযাব পাঠাবেন। কিন্তু এতোগুলো বছর হয়ে গেলো তবুও আপনার কোনো আযাব এদের ওপর আপতিত হলো না এখনো৷ এরা তো আমাকে নাস্তানাবুদ করে ছাড়ছে তাদের তিরস্কার আর বিদ্রুপে। মাবূদ, কবে পাঠাবেন আপনার সেই প্রতিশ্রুত আযাব?
কখনোই নয়! নূহ আলাইহিস সালাম একটাবারের জন্যও আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলাকে এভাবে জিজ্ঞাসার বাণে ফেলেননি। আল্লাহর প্রতিশ্রুত আযাব আসতে সুদীর্ঘ সময় লেগেছে ঠিক, এরই মধ্যে কাফিরেরা তাঁকে উপহাস, তিরস্কার আর বিদ্রুপে জর্জরিত করেছে সেটাও ঠিক, কিন্তু সবকিছু মুখ বুজে সহ্য করে তিনি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার ওপর ভরসা করে ছিলেন। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা কখন সেই আযাব পাঠাবেন, সেই সময়ের দিকে চাতক পাখির মতো তাকিয়ে থেকেছেন।
জীবনে আমরাও আল্লাহর নিয়ামত লাভের জন্য চাতক পাখির মতো তাকিয়ে থাকি। আমরা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার কাছে জীবনের দরকারে এটা-ওটা লাভের দুআ করি৷ কিন্তু যখনই আমাদের প্রত্যাশিত বস্তু লাভে আমরা ব্যর্থ হই কিংবা সেই বস্তু আমাদের হস্তগত হতে সময় লেগে যায়, আমরা তখন ব্যাকুল হয়ে উঠি। আমরা হাপিত্যেশ করে বলি, ‘আহা! আল্লাহ কেন যে আমার দুআ কবুল করেন না! কেন যে তিনি আমার ডাকে সাড়া দেন না!’
চিন্তা করে দেখুন—নূহ আলাইহিস সালামকে যে আযাবের প্রতিশ্রুতি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা দিয়েছেন তা পাঠিয়েছেন আরও একশ বছর পরে, কিন্তু কাফিরদের নিরন্তর উপহাস সত্ত্বেও এতে নূহ আলাইহিস সালামের কোনো হাপিত্যেশ কিংবা কোনো তাড়াহুড়ো ছিলো না। তিনি ধৈর্যের সাথে অপেক্ষা করে গেছেন। কিন্তু আমরা—আমাদের প্রত্যাশিত বস্তু আজকে চেয়ে কালকে না পেলে অস্থির হয়ে যাই৷ পেরেশানিতে ঘুমোতে পর্যন্ত পারি না। আল্লাহর সিদ্ধান্তের ওপর নূহ আলাইহিস সালামের যে সীমাহীন ভরসা ছিলো, আমাদের দৈনন্দিন জীবনে সেই ভরসার ছিটেফোঁটা আছে কি?
রেফারেন্স:
১. সূরা হুদ, আয়াত-৩৮
325491726 3417089178506366 117726703275744099 n

 ‘আকাশের খাতায় লেখা লজ্জার নাম’

আমাদের বোনেরা, যারা আল্লাহর বিধান পর্দাকে ভালোবেসে গ্রহণ করেছেন, যারা পর-পুরুষের দৃষ্টি হতে, তাদের সংস্পর্শ, সংস্রব হতে নিজেদের বিরত রেখেছেন, অতিশয় দরকার আর প্রয়োজন ব্যতীত যারা পর-পুরুষের সাথে কথা বলেন না, বলতে হলেও যারা শারীআহর সীমারেখার মধ্য থেকে, নিজের আব্রুকে হেফাযত করে কথা বলেন, তাদের জন্য সুসংবাদ।
আপনাদের এই বেশ-ভূষা, এই চাল-চলন, এই লজ্জাটুকু আল্লাহ পছন্দ করেছেন। আপনারা সেই নারীদের উত্তরসূরী, যারা পর-পুরুষ আছে বলে সেদিন কূপে যাওয়া থেকে বিরত ছিলো। আপনারা সেই নারীর পদচিহ্ন অনুসরণকারী, যিনি মূসা আলাইহিস সালামের সাথে প্রয়োজনীয় কথাটা বলতে এসেও নিজের লজ্জাটুকু ধরে রাখতে ভুলে যাননি। সমাজ যতোই আপনাদের অন্ধকারের বাসিন্দা বলুক, আমরা তো জানি—প্রকৃত আলোর সন্ধানটা আপনারা পেয়ে গেছেন। আপনাদের অভিনন্দন!
‘কুরআন থেকে নেওয়া জীবনের পাঠ’ বই থেকে নেওয়া টুকরো অংশ। বইটা প্রকাশ পাবে একুশে বইমেলা-২০২৩ এ, ইন শা আল্লাহ। প্রকাশ করবে সত্যায়ন প্রকাশন। credit: এই আর্টিকেলটি আরিফ আজাদের ফেসবুক পেজ থেকে কালেক্ট করা হয়েছে.